দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সংবাদটি মাঝে মাঝে আলোচনায় এলেও বাস্তবতা হচ্ছে এদেশে আন্তর্জাতিক মানের কোন মহাসড়ক নেই। আবার দেশজুড়ে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ৭৩ শতাংশ সড়কই নিম্নমানের। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ সড়কে মহাসড়কের কোন মানদণ্ডই নেই। এছাড়া ২৮ শতাংশ মহাসড়কে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের খুব কম বৈশিষ্ট্যই রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) টেকনিক্যাল এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে।
সূত্র মতে, সারাদেশে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধীনে তিন শ্রেণির মোট ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৮১৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, চার হাজার ২৪৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার জেলা মহাসড়ক রয়েছে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মহাসড়কগুলোকে ১-৫ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল রোড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের (আইআরএসপি) আওতায় এডিবি প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে বলে সওজ সূত্র জানায়। এতে বলা হয়, সারাদেশের তিন হাজার ৮১৩ কিলোমিটার এই মহাসড়কের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এর ৭৩ শতাংশই নিম্নমানের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশ মহাসড়কেই দুই লেনে বিশিষ্ট। নেই কোনো সড়ক বিভাজক (ডিভাইডার)। সড়কের দুইপাশে নেই কোনো সীমানা প্রাচীর। পৃথক লেন না থাকায় একই সঙ্গে চলে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যান। ফলে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলো অনেক বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ।
এছাড়া স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য নেই কোন পৃথক লেন। সড়কের মোড়গুলোতে যানজট লেগেই থাকে। তাই চার-ছয় লেনের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক মানের একটি ধমনী নির্মাণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক মানের মহাসড়কের কোনো বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশে সড়কে নেই। অথচ ভারতে ৫টি, শ্রীলঙ্কায় ২টি, পাকিস্তানে ১১টিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মানের ধমনী সড়কে যান চলাচল করছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামছুল হক মিডিয়াকে বলেন, আমাদের মহাসড়কগুলো বানানো হয় একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে। দুই-চার এবং চার-ছয় এভাবে মহাসড়কের পরিকল্পনা হয়। আন্তর্জাতিক মানের সড়ক নির্মাণ করতে হয় কনফিগারেশনের ওপর। কনফিগারেশন হয় দুই ধরনের। একটি হলো দ্রুতগতির যানের জন্য এক ধরনের লেন এবং স্থানীয় বা কমগতির যানবাহনের পর্যন্ত পৃথক লেন থাকবে। সমান্তরালভারে এই সড়কগুলো নির্মাণ করতে হবে।
তিনি বলেন, মহাসড়ক হতে হবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন। কোন ধরনের জংশন থাকবে এই সড়কে। এই মহাসড়ক হবে সম্পূর্ণ ধমনী সড়ক। এই সড়কে দ্রুতগতির যান ছাড়া কোন যানবাহন ঢুকতে পারবে না। এছাড়া স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা লেন থাকবে। মহাসড়কের পাশ দিয়ে দুই লেনের এই সড়ক নির্মাণ করা হবে। রাস্তার এপার থেকে ওপার যাওয়ার জন্য মহাসড়কের নিচ দিয়ে আন্ডারপাস তৈরি করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় মহাসড়কগুলো দুই লেনের। সড়কের দুই পাশে নেই কোনো সীমানা প্রাচীর। আর লম্বাপথ পরিভ্রমণে সড়কের পাশে যানবাহন থামার কোনো ব্যবস্থাও নেই। অর্থাৎ মহাসড়কের কোনো বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশে দেখা যায় না। ফলে এগুলোকে মহাসড়ক বলাই কঠিন।
এডিবি’র প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম (এন-১) মহাসড়কের ৮৭ শতাংশ নিম্নমানের। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ কালো তালিকা বা এক তারকা গ্রেডের। আর ১৫ শতাংশ লাল তালিকা বা দুই তারকা গ্রেডের। এছাড়া ঢাকা-সিলেট (এন-২) মহাসড়কের ৪৪ শতাংশ, ঢাকা-ময়মনসিংহ (এন-৩) মহাসড়কের ৯৩ শতাংশ, জয়দেবপুর-জামালপুর (এন-৪) মহাসড়কের ৬০ শতাংশ, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা (এন-৪০৫) ৫৭ শতাংশ, ঢাকা-বাংলাবান্ধা (এন-৫) মহাসড়কের ৭৬ শতাংশ, কাশিনাথপুর-রাজশাহী (এন-৬) মহাসড়ক ৮১ শতাংশ, দৌলতদিয়া-মোংলা (এন-৭) মহাসড়ক ৭৫ শতাংশ ও ঢাকা-পটুয়াখালী (এন-৮) মহাসড়ক ৮২ শতাংশ নিম্নমানের। গুণগত মানের দিক থেকে খারাপ হওয়ায় বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটিতে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ মহাসড়কের চেয়ে ১০গুণ বেশি দুর্ঘটনা হয়। অন্যান্য মহাসড়কের অবস্থাও একই রকম। ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ মহাসড়ক বিশ্বের মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ সড়কের তালিকায় রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মহাসড়ক ন্যূনতম ৪ লেন ও সড়ক বিভাজক থাকতে হয়। অথচ বাংলাদেশের ৯৬ শতাংশ মহাসড়কই দুই লেনের। ফলে এগুলোতে নেই কোনো সড়ক বিভাজক। তবে ৭৭ শতাংশ মহাসড়কের মাঝে বিভাজক লাইন চিহ্ন টানা আছে। এছাড়া ১০০ ভাগ মহাসড়কেই সাইকেল বা অযান্ত্রিক যানের জন্য পৃথক লেন নেই। মাত্র ১ শতাংশ মহাসড়কের দুই পাশে নিরাপত্তামূলক বেষ্টনী বা সীমানা প্রাচীর রয়েছে। ৭৬ শতাংশ মহাসড়কের পাশে গাছপালা রয়েছে। তবে অধিকাংশ সড়কের বাঁকে গাছ দৃষ্টি প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
আর ৯০ শতাংশ সড়কের ঢালু ঠিকভাবে না থাকায় বৃষ্টির পানি জমে যায়। এছাড়া কোনো মহাসড়কেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। ৯৯ শতাংশ সড়কের উপরি ভাগের (পেভমেন্ট) পুরুত্ব ১ মিটারের কম। মহাসড়কে অবস্থিত ৯৫ শতাংশ মোড়েই কোনো ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই। ৩৫ শতাংশ মহাসড়ক খুবই সরু বা অপ্রশস্ত। আর ৪০ শতাংশ মহাসড়ক মাঝারি ধরনের প্রশস্ত। তবে এগুলোতে মোটর বাইকের চলার জন্য পৃথক কোনো ব্যবস্থা নেই।
সব মহাসড়কেই পথচারী হাঁটতে দেখা যায়, যা মহাসড়কের বৈশিষ্ট্য নয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মহাসড়কের প্রায় তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ধরনের স্থাপনা বা বসতভূমি থাকে না। অথচ বাংলাদেশে ৩৭ শতাংশ মহাসড়কের পাশে রয়েছে কৃষিজমি। এছাড়া ২১ শতাংশ মহাসড়কের পাশে বসতভূমি, ২৬ শতাংশের পাশে বাণিজ্যিক স্থাপনা (দোকান, বাজার প্রভৃতি) ও ৩ শতাংশের পাশে শিল্প-কারখানা রয়েছে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন