খোলাবাজারে চাল বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন আমন ও মজুদকৃত বোরোর ওপর চাপ আরও বাড়বে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ ভরমৌসুমেও চালের দর নিম্নমুখী হওয়ার প্রবণতা কমবে। পাশাপাশি চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের লাগাম সরকারের হাত থেকে আরও আগলা হয়ে পড়বে।
চলতি বছরের জুন থেকে সারাদেশে ধান-চালের ব্যাপক ঘাটতি এবং লাগামহীনভাবে এর মূল্য বৃদ্ধির মুখে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি (ওএমএস) শুরম্ন হলেও এখন তা বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৫ ডিসেম্বর থেকে এ কর্মসূচি গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতে এরইমধ্যে খাদ্যপণ্যের বাজারে নতুন করে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ওএমএসের ওপর নির্ভরশীল হতদরিদ্র পরিবারগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
বাজার সংশিস্নষ্টদের ধারণা, খোলাবাজারে চাল বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন আমন ও মজুদকৃত বোরোর ওপর চাপ আরও বাড়বে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ ভরমৌসুমেও চালের দর নিম্নমুখী হওয়ার প্রবণতা কমবে। পাশাপাশি চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের লাগাম সরকারের হাত থেকে আরও আগলা হয়ে পড়বে। এ সুযোগ চাতাল মালিক, অটো রাইস মিলার, আমদানিকারক ও দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা মিলে ফের 'চালবাজি'তে মেতে উঠতে পারে বলে বাজার পর্যবেক্ষকরা জোরালো আশঙ্কা করছেন।
গত ১১ নভেম্বর খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আরিফুর রহমান অপুর স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, আমন চাল সংগ্রহ শুরম্ন হওয়ায় হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা ছাড়া ঢাকা মহানগরসহ অন্যান্য বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও উপজেলাবহির্ভূত পৌরসভায় ওএমএস খাতে চাল ১৫ ডিসেম্বর থেকে বিক্রি বন্ধ থাকবে। এ চিঠির অনুলিপি ইতোমধ্যেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রকের বরাবরে পাঠানো হয়েছে। এরইমধ্যে মাঠপর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারা ওএমএস কর্মসূচি গুটিয়ে নেয়ার তোড়জোড় প্রস্তুতি শুরম্ন করেছে।
এদিকে এ নিয়ে দেশের হতদরিদ্র পরিবারগুলোর মাঝে হতাশার পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষোভও সৃষ্টি হয়েছে। চালের বাজার স্থিতিশীল পর্যায়ে না এনে ওএমএস কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার তীব্র বিরোধিতা করে তারা বলেন, কয়েক কোটি নিম্নবৃত্ত অসহায় মানুষের কথা না ভেবে সরকার এ ধরনের পিছুটান দিয়েছে। গম-আটা, তেল-চিনি ও শাকসবজিসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের বাজারে চালও চড়া দরে কিনতে হলে হতদরিদ্রদের নাভিশ্বাস উঠবে বলেও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ঢাকা অঞ্চলের মাঠপর্যায়ের একাধিক খাদ্য কর্মকর্তা জানান, ১৫ ডিসেম্বর থেকে ওএমএস কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণার বিষয়টি তারা ঢালাওভাবে প্রচার না করলেও নানা মাধ্যমে এর সুবিধাভোগীরা তা জেনে গেছে। তাই কেউ কেউ আগেভাগেই ওএমএস ডিলারদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণ চাল কিনে তা ঘরে মজুদ রাখার চেষ্টা করছেন। তবে সঞ্চয় না থাকায় বেশিরভাগ মানুষ তাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। চালের দর স্থিতিশীল পর্যায়ে না এনে ওএমএস কর্মসূচি গুটিয়ে নেয়া হলে সত্যিকার অর্থেই হতদরিদ্ররা বিপাকে পড়বে বলে মনে করেন তারা।
খাদ্য কর্মকর্তারা জানান, বাজারে এখনো মোটা চাল ৪০ থেকে ৪২ টাকা এবং মাঝারি মানের চাল ৪৮ থেকে ৫৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় ওএমএস বন্ধ করে দেয়ায় নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তদের শুধু চাল ক্রয় খাতেই মোটা অংকের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। যা অনেকের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে চালের বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আগেই ওএমএস বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও চরম বিব্রত। তাদের ভাষ্য, খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দরের কারণে তারা এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে নানা ধরনের চাপে আছেন। এর ওপর ভর আমনের মৌসুমে চালের বাজারে উত্তাপ থাকায় তাদের ভোটব্যাংকে ভাটার টান ধরেছে। এ সময় ওএমএস বন্ধ হলে আগামী নির্বাচনে সাধারণ জনগণের সমর্থন পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে হতদরিদ্র মানুষ তাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত্ম নেয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করেন জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই।
তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এসব বিষয়ে দৃষ্টি থাকলেও ওএমএস চালু রাখার কোনো পথ সরকারের সামনে খোলা নেই। কেননা সরকারি গুদামে চালের মজুদ অনেক আগেই তলানিতে পৌঁছেছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বাইরে থেকে যে আতপ চাল আমদানি করা হয়েছিল তা এতদিন ওএমএসে দেয়া হয়েছে। এর ছোট একটি অংশ উদ্বৃত্ত থাকলেও তা আপদকালীন সময়ের জন্য সরকার ধরে রাখতে চাইছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা ইসু্য চলমান রয়েছে। তাই সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই ওএমএস বন্ধ করে দিয়েছে।
যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকরা কেউ কেউ এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাদের ভাষ্য, দেশে আমনের ভর মৌসুম চলছে। চাল উৎপাদনও মোটামুটি ভালোই হয়েছে। তাই কয়েকদিনের মধ্যে চালের বাজারে উত্তাপ আরও কমবে। এ অবস্থায় ওএমএস চালু রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মন্ত্মব্য করেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুলনা অঞ্চলের খাদ্য অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে একটা লম্বা সময় ধরে প্রান্ত্মিক জনগোষ্ঠীরা চরম কষ্টে আছে। দাম বৃদ্ধির পর থেকে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি, সরকারিভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে চাল কেনাসহ সরকারের নানা উদ্যোগের পরও বাজারে এর খুব একটা প্রভাব পড়েনি। এখনো চালের দাম দরিদ্র মানুষের নাগালের মধ্যে আসেনি। কিন্তু মজুদ কম থাকার অজুহাতে খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএসএম) কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। যা চালের বাজারে নতুন করে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে খোলাবাজারে চাল বিক্রি চালু রাখা প্রয়োজন- মনে করেন খাদ্য অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন