আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ। একটি দল যখন ক্ষমতায়, রাজনীতির মাঠে অপরটি তখন প্রধান বিরোধী দল। অনেক বড় বড় নেতা এ দুটি দল থেকে বেরিয়ে চেয়েছেন নতুন প্লাটফর্ম গড়তে, জাতিকে নতুন স্বপ্ন দেখাতে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদের বিচারে দলছুট নেতারা তাদের তারকাদ্যুতি দিয়েও পারেননি বড় কোনো দল গড়তে। উপরন্তু দিন দিন হয়ে পড়েছেন নিষ্প্রভ। কেউ কেউ হারিয়ে গেছেন রাজনীতির কক্ষপথ থেকেও। কক্ষচ্যুত অনেক নেতার নাম পর্যন্ত মুছে গেছে মানুষের মন থেকে। বারবার প্রমাণ হয়েছে, এ দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই শেষ কথা
জোট সরকারের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং দলে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে পৃথক দল গঠন করেন তৎকালীন বিএনপির প্রভাবশালী দুই নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও কর্নেল (অব) অলি আহমদ। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার হয়ে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের লক্ষ্যে নতুন দল করেন আরেক নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। কিন্তু তাদের কেউই সফল হননি। দলীয় সাফল্যের বিবেচনায় বলা যায়, তারা কেউ ভালো নেই।
তাদের সঙ্গে কথা বলেও মনে হয়েছে ভালো নেই তারা। ঠিক যেমনটি চেয়েছেন তেমনটি নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে গিয়ে কিছু করা যে কঠিন, সে বাস্তবতার হিসাব মেলাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখনই তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠেন এসব দলত্যাগী বা বহিষ্কৃত।
জোট সরকারের সময় বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রিয়ভাজন হন এসব নেতা। তারা উভয়ই ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু বি. চৌধুরী ও অলির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত টেকেনি। এখন তাদের সঙ্গে দৃশ্যমান কোনো সম্পর্ক নেই। সময়ের পালাবদলে অলি আহমদ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে।
বি. চৌধুরীকে এখন বিএনপির মিত্র দল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সময়ের স্রোতে কয়েক বছর ইফতার মাহফিলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক মঞ্চে বসেন। বিএনপির সঙ্গে তার যোগাযোগও ভালোই। সম্প্রতি বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে চারদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠন করে গণমাধ্যমে বেশ আলোচনায় রয়েছেন। তাদের অবস্থান সরকারবিরোধী। বিএনপির দাবির সঙ্গে তাদের মিল থাকলেও তা একসূত্রে গাঁথা নয়। তাই এখন আওয়ামী লীগের তো নয়, বিএনপির দিকেও ঝুঁকছেন না।
অন্যদিকে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এ পর্যন্ত চারটি দলের ‘জন্ম’ দিয়েছেন। তার প্রতিটি দল গঠনই বিএনপি কর্মকা- সমালোচনা করে। তার পরও তার শান্তি নেই। তিনি এখন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে বেশ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
অবশ্য এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব) অলি আহমদ মনে করেন, দেশের পঞ্চম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল তার। আমাদের সময়কে বলেন, আমরা দেশের পঞ্চম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। সারা দেশে আমাদের ৭০ থেকে ৮০ আসনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। তার পরও আমরা ২০ দলীয় জোটের সিদ্ধান্ত মেনে শরিক দল হিসেবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেব। তবে যেখানে বিএনপির অবস্থান ভালো থাকবে, তাদের ভালো প্রার্থী থাকবে, সেখানে প্রার্থী দেব না। অর্থাৎ জোটের কাছে আমাদের কোনো অন্যায় আবদার থাকবে না।
এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, বিএনপি থেকে বের হয়ে আসা এবং বর্তমানে ২০ দলীয় জোটে থাকাÑ উভয় সিদ্ধান্তই সঠিক। ভালো কিংবা খারাপ বিচার করবে জনগণ।
তিনি বলেন, আমাদের ৬০ জেলায় কার্যক্রম রয়েছে। আগামী নির্বাচনে চট্টগ্রাম থেকে কর্নেল (অব) অলি আহমদ, কুমিল্লা থেকে ড. রেদোয়ান আহমেদ, লক্ষ্মীপুর-১ থেকে নিজের আসনসহ ৩০টি আসনে তারা মনোনয়ন চাইবেন। ৩০ ডিসেম্বর কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বর্ধিত সভা হবে। সেখান থেকে সবার মতামতে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত হবে।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডা. একিউমএম বদরুদ্দোজার সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগে করা যায়নি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হয় বিএনপি থেকে বের হয়ে গিয়ে এখন কেমন আছেন? কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, ভালো আছি। বিবেকের কাছে পরিষ্কার আছি। সম্মান নিয়ে বাস করছি। তবে বিএনপিতে ফিরে যাওয়ার কথা মনে করতে চাইলেও মনে করা সম্ভব নয়।
মাহী বলেন, যখন মাঝে মাঝে ভাবি তখন মনে হয় কী চমৎকার দল ছিল বিএনপি। এখন সে দলকে আগের জায়গায় নেওয়া সম্ভব নয়Ñ এমনটিও মনে হয় তার।
দলের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, সাংগঠনিকভাবে দলকে আরও শক্তিশালী করতে নতুন বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাতীয় কাউন্সিল হবে। এ কাউন্সিলে দেশের সব জেলার নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এক প্রশ্নে মাহী বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিকল্পধারা বাংলাদেশের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় যুক্তফ্রন্ট ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। সে ক্ষেত্রে বিকল্পধারা যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবে।
অপর এক প্রশ্নে বিকল্পধারা বাংলাদেশের এ নেতা বলেন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের যে অবস্থান, এখনো রয়েছে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বিষয়ে বিএনপি শাসনামলের সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমল তুলনা করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ব্যর্থতা থেকেই আমাদের চারদলীয় যুক্তফ্রন্টের জন্ম।
তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, একটা সময় একটি বড় দলের নেতৃত্ব ছিলাম। এখন নতুন দল করছি। হয়তো প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্জন করতে পারিনি। সেদিক থেকে ভালো নেই। তবে নতুন দলকে প্রতিষ্ঠিত যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে। সে ব্যাপারে আশাবাদী।
তিনি বলেন, সাংগঠনিক অবস্থার বিচারে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫ ভাগ আসনে আমাদের প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। আর দেশে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও আওয়ামী লীগবিরোধী দুই ধরনের ভোট রয়েছে। আমাদের টার্গেট আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটারদের। অন্যদিকে বিএনপির থেকে বঞ্চিত জনপ্রিয় যোগ্যপ্রার্থীকে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ১৪-১৫ জেলায় এখন পর্যন্ত তাদের কমিটি রয়েছে। নতুন বছরের জানুয়ারি মাস থেকে টার্গেটকে বাস্তবে রূপ দিতে জেলা সফরে বের হব।
আওয়ামী লীগের শাসনামলকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছে এবং ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। তারা যেটা পারেনি অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, এখানে আমরা ভূমিকা রাখতে চাই। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা করব নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে। এতে যদি তার দলের পরাজয়ও হয়, এটা তার জন্য সম্মানের সঙ্গে এক্সিট হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশের যে পরিমাণ উন্নয়ন করছেন, তার পরাজিত হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। বিএনপির সঙ্গে জোট করার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানান সাবেক এ যোগাযোগমন্ত্রী।
এর বাইরে ওয়ান-ইলেভেনের সময় নতুন দল করেন বিএনপির প্রথম যুগ্ম মহাসচিব ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। তার দলের নাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল-পিডিপি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ব্যাপক আলোচিত দল পরে আর এগুতে পারেনি। বর্তমানে কোরেশীও খুবই অসুস্থ, শয্যাশায়ী। তার স্ত্রী দলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে এগুচ্ছে ধুঁকে ধুঁকে।
স্বৈরাচার এইচএম এরশাদের শাসনামলে মহাসচিব থাকা অবস্থায় কেএম ওবায়দুর রহমান বিএনপি ছেড়ে জনতা নামে নতুন দল গঠন করেন। ব্যর্থ হয়ে ফের বিএনপিতে ফিরে আসেন। প্রয়াত এ নেতার মেয়ে শামা ওবায়েদ এখন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন