জেলার গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় আসন হিসেবে পরিচিত গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ। গাইবান্ধা জেলা সদরের প্রবেশ দ্বার এই গোবিন্দগঞ্জ। এ উপজেলা সদরের বুক চিড়ে চলে গেছে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক। ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ গোবিন্দগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। শিল্প সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রেও এ উপজেলা অনেক এগিয়ে। আয়তনের দিক দিয়েও জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় উপজেলা। এর ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে সংসদীয় আসন গঠিত। রাজনৈতিক অঙ্গনেও সব দল সরব। সারা দেশের মতো এ উপজেলাতেও নির্বাচনী হাওয়া জোরেশোরে লেগেছে। বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচন নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছেন। এক সময় জেলার অন্য আসনের মতো এ আসনটিও জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। পরে চলে যায় বিএনপির হাতে। এখন আওয়ামী লীগের কব্জায়। নবম সংসদ নির্বাচনে এ আসনটিতে বিজয়ী হয়েছিলেন এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনে তিনি হেরে যান আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের কাছে। আবুল কালাম আজাদ এখন আওয়ামী লীগের উপজেলা সভাপতি।
দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ না নিলেও এবার তারা তৎপর। ইতিমধ্যে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমে জনসংযোগে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা নতুন সদস্য সংগ্রহ এবং পুরনো সদস্য নবায়নের মাধ্যমে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরেশোরে শুরু করেছেন। পাশাপাশি তারা উঠান বৈঠক এবং ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনসংযোগ করছেন। বিএনপির একাধিক নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী। বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী কে হবেন এখনই তা বলার সময় আসেনি। তবে এ আসনটিতে জামায়াতও দাবিদার। জাতীয় পার্টির দখলে এ আসনটি থাকলেও এখন তারা কিছুটা পিছিয়ে। দলীয় চেয়ারম্যান এখনো এ আসনে কাউকে মনোনয়ন দেননি বা কোনো নাম ঘোষণা করেননি। তবে স্থানীয়ভাবে দলের উপজেলা আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মশিউর রহমান মনোনয়নের জন্য নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছেন। এতে সাংগঠনিক কার্যক্রম যেমন বেড়েছে তেমনি জনসংযোগেও তারা সক্রিয় হয়েছেন।
অবশ্য সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্য দলগুলোও কিছুটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। তারাও সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করছে। সবকিছু মিলিয়ে গোবিন্দগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরগরম। নির্বাচনী হাওয়া লেগেছে উপজেলার সর্বত্র।
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম সামনে উঠে এসেছে তারা হচ্ছেন বর্তমান এমপি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র আতাউর রহমান সরকার, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিমাগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় পাট ও বস্ত্র বিষয়ক সম্পাদক নাজমুল ইসলাম লিটন।
এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। তারা স্থানীয়ভাবে গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছেন। তাদের খবর নিচ্ছেন। পাশাপাশি তারা তৃণমূল পর্যায়ে তেনাকর্মীদেরও কাছে টানার চেষ্টা করছেন। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারণায় এ আসনের ভোটাররা এখনই নির্বাচনী আমেজ খুঁজে পাচ্ছেন।
মনোনয়ন প্রত্যার্শী সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন চৌধুরী সাধারণ মানুষের কাছে একজন সাদামাটা এবং বিনয়ী মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি যখন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন তখনই এলাকায় রাস্তাঘাট উন্নয়ন এবং ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণে প্রচুর কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রচুর উন্নয়ন কাজ করেছেন। এ জন্য এলাকায় তিনি জনপ্রিয়। মনোয়ার চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি নিশ্চিত বিজয়ী হবেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে এমপি আবুল কালাম আজাদ একজন ডাইনামিক পার্সন হিসেবে পরিচিত। তিনি গোবিন্দগঞ্জ আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছেন। সংগঠক হিসেবে তার তুলনা নেই। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর এলাকায় ফিরে আসেন। তিনি ফুলপুকুরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন। পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
আবুল কালাম আজাদ গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে পর পর দু’বার নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেই তিনি পদত্যাগ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পরিচিত হন এবং আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে প্রায় ৩৫ হাজার ভোটে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও দল তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। বরং নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগের সংসদীয় গ্রুপে শামিল হন।
এমপি আবুল কালাম আজাদ বলেন, গোবিন্দগঞ্জবাসীর সুুখে দুঃখে আমি তাদের পাশে রয়েছি। জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করে এখানে শান্তিময় পরিবেশ তৈরি করেছি। এ উপজেলায় অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করার আর সুযোগ নেই। আমি তা হতে দেবো না। উন্নয়নের ক্ষেত্রে গোবিন্দগঞ্জের সঙ্গে অন্য উপজেলার তুলনা হবে না। প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিলে এ আসনটি পুনরায় তাকে উপহার দিতে পারব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী পৌর মেয়র আতাউর রহমান সরকার। রাজনৈতিক পরিবার থেকে তিনি এসেছেন। তার পিতা দীর্ঘদিন ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। আতাউর রহমান জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কলেজ জীবনে। গোবিন্দগঞ্জে কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দল সংগঠিত করতে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি গোবিন্দগঞ্জ পৌর সভার জনপ্রিয় মেয়র। তিনি গোবিন্দগঞ্জ শহরকে আধুনিকায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি আসনটি তাকে উপহার দিতে সক্ষম হবেন বলে আশা পোষণ করেন। এ উপজেলায় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থাকলেও নির্বাচনে একাট্টা হয়ে সবাই কাজ করবেন বলে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন।
এদিকে এ আসনটিতে বিএনপিরও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। প্রয়াত এমপি এম এ মোত্তালিব ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে খুব জনপ্রিয়। তিনি বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর দলটি শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এমপি থাকাবস্থায় তিনি মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে হৃদরোগে মারা যান। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে তার ছেলে শামীম কায়সার লিংকন উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দল এবং পারিবারিক জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখেন। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে শামীম কায়সার লিংকন ছাড়াও রয়েছেন বর্তমান উপজেলা সভাপতি সাবেক এমপি আবদুল মান্নান মণ্ডল, সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক কবির আহমেদ, পৌর বিএনপি সভাপতি ফারুক আহমেদ। আবদুল মান্নান মণ্ডল বলেন, দলের চেয়ারপার্সন যাকেই মনোনয়ন দিন না কেন তার পক্ষেই সমস্ত নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। তবে সবকিছুই নির্ভর করবে নির্বাচনের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের ওপর। সাধারণ ভোটারদের ধারণা সাবেক এমপি শামীম কায়সার লিংকনকে মনোনয়ন দেয়া হলে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী এমপি আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে তার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
জামায়াত সারা দেশের মতো এ আসনেও কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে। প্রকাশ্যে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। দলের নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ কারাবাস করে এখন বাইরে এসে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে তাদের জেলা সভাপতি ডা. আবদুর রহিম সরকারকে তারা প্রার্থী হিসেবে চাইবেন।
জেলার অন্য আসনের মতো এ আসনটিও ছিল জাতীয় পার্টির দখলে। লুৎফর রহমান চৌধুরী এ আসন থেকে পর পর তিন বার এমপি নির্বাচিত হন। দশম সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র দাখিল করেও দলীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। লুৎফর রহমান চৌধুরী এখন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপিতে। তিনি দল থেকে চলে যাওয়ায় জাতীয় পার্টি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে দলের হাল ধরে আছেন উপজেলা আহ্বায়ক রংপুর নার্সিং ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ মো. মশিউর রহমান। তার নেতৃত্বে দুর্বল হয়ে পড়া জাতীয় পার্টি নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তিনি দলে এসেই ঘর গোছানোর কাজ শুরু করেন। এখন প্রত্যেক ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায় কমিটি রয়েছে। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির নেতারা সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি জনসংযোগেও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তারা হারানো আসনটি ফিরে পেতে চান।
উপজেলা আহ্বায়ক মশিউর রহমান জানান, নেতৃত্বে দুর্বলতা এবং সাংগঠনিক তৎপরতার অভাবে দলের অস্তিত্ব ধরে রাখাই কঠিন ছিল। তিনি দলের হাল ধরার পর সহযোগিদের সহায়তায় গ্রামগঞ্জ চষে বেড়িয়ে সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত এখন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। গোবিন্দগঞ্জবাসী এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এবার বিজয়ী হয়ে আসতে পারে। তাই জনগণ জাতীয় পার্টির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন