বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য এমনিতেই অনুকূল নয়। তার উপর হালসময়ে অনেকটা লাগামহীন কায়দায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে। অথচ সেই হারে বাড়ছে না রপ্তানি আয়। ফলে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি।
পরিসংখ্যান মতে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৬২ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ৭০ হাজার কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প যেমন, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। তাই মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে অনেক বেশি। চাল ও পেঁয়াজ আমদানিও বেড়েছে। পাশাপাশি টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তি। এসব কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির কারণে উৎপাদন বাড়ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর শেষে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬২ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৫১ কোটি ১০ লাখ ডলার। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৪১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার (প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা) বা ৯১ শতাংশের বেশি। যার প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি)।
প্রতিবেদন মতে, ডিসেম্বর শেষে ইপিজেডসহ রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের আয় হয়েছে এক হাজার ৭৬৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ৬৩১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসেবে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৮৬২ কোটি ৮০ ডলার বা ৭০ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। আলোচিত সময়ে, আমদানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। রপ্তানি বেড়েছে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অন্যদিকে রেমিট্যান্স বেড়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বড় হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছর উদ্বৃত্তের ধারা অব্যাহত থাকলেও গত অর্থবছরে ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। ডিসেম্বরেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরজুড়ে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। তখন বৈদেশিক দায় পরিশোধে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১৪৮ কোটি ডলার ঋণাত্মক হয়, যা এখনও অব্যাহত রযেছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের ডিসেম্বর শেষে ৪৭৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী এর পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা এর আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল ৫৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
আলোচ্য সময়ে সেবাখাতে বিদেশীদের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে ৪৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। আর বাংলাদেশ এ খাতে আয় করেছে মাত্র ২০৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ হিসেবে ছয় মাসে সেবায় বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২২৮ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৬ষ্ঠ মাসে ছিল (ঘাটতি) ১৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
প্রতিবেদন মতে, ডিসেম্বর শেষে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মোট ১০৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগও সামান্য বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের আলোচিত মাসে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হয়েছে ২০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম মিডিয়াকে বলেন, সাধারণত বাণিজ্য ঘাটতি মেটানো হয় রেমিট্যান্স ও বিদেশী বিনিয়োগ দিয়ে। কিন্তু এ খাতেও কিছুটা নিম্নগতি রয়েছে। ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। যা অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। আমদানির নামে অর্থপাচার হচ্ছে কি-না তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সিনিয়র গবেষণা ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়লে উৎপাদন বাড়ার কথা। আর উৎপাদন বাড়লে রপ্তানি বাড়বে। বিপরীতে আমদানি কমে আসবে। তখন আমদানি-রপ্তানির মধ্যে সমন্বয় হওয়ার কথা। কিন্তু এখন দেখার বিষয় হলো আসলে উৎপাদন হচ্ছে কি না। এছাড়া এ বছর চাল ও পেঁয়াজ আমদানিও বেড়েছে। এ কারণে ঘাটতি ও বেড়েছে। তবে এতে ভয়ের কিছু নেই বলে মনে করেন তিনি।
ব্রেকিংনিউজ/
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন