জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রায়ে ৫ বছর সাজা হওয়ায় প্রচলিত আইনে তার নির্বাচন করার সুযোগ নেই। খালেদা জিয়ার দল বিএনপির অভিযোগ, তাদের নেত্রীকে আগামী জাতীয় নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই বর্তমান সরকার সাজানো মামলায় কারাদণ্ড দিয়েছে।
দুদকের দায়ের করা এই মামলায় ৮ ফেব্রুয়ারি সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যালোচনাসহ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন বিশেষ জজ-৫ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান।
এতে খালেদা জিয়াকে ৫ এবং তারেক রহমানসহ বাকি আসামিদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও ট্রাস্টের নামে আত্মসাৎ হওয়া ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা প্রত্যেককে সমপরিমাণ করে জরিমানা করা হয়েছে।
এর পরের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি রায়ের সত্যায়িত কপি নিয়ে হাইকোর্টে সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। একাধিক গ্রাউন্ডে যুক্তি তুলে ধরে তার খালাস এবং জামিন আবেদন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আপিল গ্রহণ করে বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়াকে করা অর্থদণ্ড স্থগিতের আদেশ দেন।
একই সঙ্গে এ মামলায় বিচারিক আদালতের সকল নথি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে পাঠাতে সংশ্লিষ্ট আদালতকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় জামিন চেয়ে খালেদা জিয়ার করা আবেদনে আগামী রোববার শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।
দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার পরই আগামী নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ করতে পারা, না পারার বিষয়টি ঘুরে ফিরে সামনে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে আদৌ কি তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন?
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘এখন যে আবেদন করা হয়েছে, তাতে সাজা স্থগিত করা সম্ভব হয় না। পরে ভিন্ন আইন আছে, সেই অনুপাতে আবেদন করা হবে। একটা হলো যদি আপিল পেন্ডিং থাকে, তাহলে আবেদনের দরকার হয় না।’
তিনি বলেন, ‘আপিল পেন্ডিং থাকলে নির্বাচনে বিএনপি নেত্রীর অংশগ্রহণে কোনো বাধা থাকবে না। আবার সাজা স্থগিত না হলে নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।’
খালেদা জিয়ার এই আইনজীবী জানান, আদালত জামিন আবেদনের শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন। মামলার নথিগুলো হাইকোর্টে জমা দিতে বলেছেন, এগুলো পেপার বুক হবে। শুনানির সময় নির্ধারণ করা হবে। তখন আমরা আইনগত সব বিষয় আদালতে তুলে ধরব। আইনি বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘সবকিছুই তো আইন অনুযায়ী চলবে না। তারপরও কথা আছে না ‘কেষ্ট বেটাই চোর’। সুতরাং খালেদা জিয়া নির্বাচনে থাকতে পারছেন কিনা, তা এখনই শেষ বলার সুযোগ আসেনি।’
বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী আদালতকে বলেন, ‘ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১০(১) ধারায় আপিলটি করা হয়েছে। আমি আপিল শুনানির জন্য গ্রহণের আবেদন করছি। আপিল গ্রহণ হলে জামিন আবেদন দেয়া হবে। ৪০৯ ধারায় আপিলকারীকে সাজা দিয়েছে ওই (বিচারিক) আদালত।’
তখন আদালত তাকে বলেন, ‘অ্যাডমিশনে কি প্রেয়ার আছে, না শুধুই আপিল অ্যাডমিশন চেয়েছেন? অ্যাডমিশনে পরে আর কি প্রেয়ার আছে?’
তখন মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘একটা আপিল অ্যাডমিশনের আবেদনে নরমালি যা যা থাকে আমরা তাই চেয়েছি।’
তখন নথি থেকে আদালত বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সাজা বা দণ্ড স্থগিতের বিধান আছে। কনভিকশন কি স্থগিত করা যায়? ক্রিমিনাল অ্যাক্ট ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে কনভিকশন স্থগিতের বিধান নেই। আপনারা তো কনভিকশনও স্থগিত চেয়েছেন।’
এ পরিপ্রেক্ষিতে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এটা গতানুগতিক, এটা ঠিক করে দেব। সাধারণত এটা একটা প্রথা। সেজন্য এটা আমরা চেয়েছি।’
পরে আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন এবং আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে মামলার সকল নথি তলব করেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ।
জামিন আবেদন বিষয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘১৫ দিন ধরে তিনি (খালেদা জিয়া) কারাগারে আছেন। যেহেতু তাকে শর্ট সেনটেন্স দেয়া হয়েছে, সেজন্য আমরা তার বেইল (জামিন) চাচ্ছি। বয়স ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় জামিন পাওয়ার হকদার তিনি।’
তখন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আপিল ইতোমধ্যে আদালত গ্রহণ করেছেন। আজকে সকালে আমরা জামিন আবেদন পেয়েছি। রেকর্ড আসার পরই বিষয়টি লিস্টে এনে শুনানি করা হোক।’
এই পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আপিলকারীর সাজা তো কম। আদালতের প্রথা আছে সাজা কম হলে জামিন দেয়ার। এই মামলায় মেরিট আছে। এ কারণে এটা আমরা কার্যতালিকায় এনে শুনানি করতে চাই।’
ফলে আজই নির্ধারিত হয়ে যায় রোববারের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো সুযোগ নেই। আগামী রোববার জামিনের ওপর শুনানির পর বুঝা যাবে কবে নাগাদ তিনি মুক্তি পাচ্ছেন?
এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজাক খান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘জামিনের ওপর শুনানির জন্য আগামী রোববার দিন ধার্য হয়েছে। এর আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী সগীর হোসেন লিওন জানান, আমাদের পক্ষ থেকে বয়স, অসুস্থতাসহ প্রায় ৩২টি গ্রাউন্ডে ৪৫টি প্যারায় ৮৮০ পৃষ্ঠার জামিন আবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, সেনা সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২০০৯ সালের ৫ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ। মামলার দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ খালেদা জিয়াসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং দুদক আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন।
এরপর ২৩৬ কার্যদিবসে, ৩২ জনের সাক্ষ্য নেয়ার মধ্য দিয়ে এ মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। এর মধ্যে ২৮ দিন ধরে আসামি খালেদা জিয়া ৩৪২ ধারায় জবানবন্দি দেন। আর ১৬ দিন তার পক্ষ থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবীরা।
তারেক রহমান ছাড়া মামলায় অন্য আসামিদের মধ্যে মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ কারাগারে রয়েছেন। আর সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন