আসামের মুসলিম ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের মন্তব্যে ভারতজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনীর পদে অধিষ্ঠিত থেকে কেউ এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারেন কি না- এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
এর আগে বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) আসামে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সীমান্ত নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিয়ে বিপিন রাওয়াত বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিপুল অভিবাসী যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। এই ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ ও চীনের সহায়তায় ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ হিসেবে মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেন, আসামের অনেক জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ওই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতেই এই কাজ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তার ভাষায়, মুসলিমপ্রধান দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) নেতা বদরুদ্দিন আজমলের নেতৃত্বে এই কাজ করা হচ্ছে। আসামে বিজেপির চেয়ে এআইইউডিএফ এগিয়ে বলেও উদ্বেগ জানান বিপিন।
ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেন, আমাদের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রতিবেশীর কারণে একটি পরিকল্পিত অভিবাসন ঘটছে। প্রক্সি যুদ্ধের পদ্ধতিতে তারা সব সময়ই এই অঞ্চলটি দখলে নেয়ার চেষ্টা করবে ও তা নিশ্চিত করতে চাইবে।
ভারতীয় গণমাধ্যম স্ক্রলের মতে, বিপিন রাওয়াত তার বক্তব্যে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি দল ভূখণ্ড দখলের আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করতো। এছাড়া সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের নাম সম্বোধন করে কোনো ধরনের বক্তব্য সেনাবাহিনীর আচরণবিধির পরিপন্থী। বিপিন রাওয়াত শুধু রাজনৈতিক দলের নামই সম্বোধন করেননি, মুসলিমপ্রধান দল এআইইউডিএফের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন।
এর আগে ভারতের লোকসভার মুসলিম সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ভারতীয় মুসলিমরা দেশপ্রেমিক নয়- এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, সম্প্রতি কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় যে সাত সেনা নিহত হয়েছে, তাদের পাঁচজনই মুসলিম। অনেকের অভিযোগ, ভারতের স্বার্থে শুধু হিন্দুরাই জীবন দেয়- এমন মত প্রতিষ্ঠা করতেই ভারতীয় সেনাপ্রধান ওই মন্তব্য করেছেন।
সমালোচকরা মনে করছেন, ভারতে বর্তমানে জনজীবনের সামরিকীকরণ চলছে। রাজনৈতিক বিষয়ে চাকরিরত ও সাবেক সেনা কর্মকর্তারা মন্তব্য করছেন। রাজনীতি ও সেনাবাহিনীকে দিন দিনই জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।
আসামের মুসলিম দলকে কটাক্ষ করলেন ভারতের সেনাপ্রধান
ঢাকা: ভারতে বদরুদ্দিন আজমলের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এআইইউডিএফ কীভাবে আসামে বিজেপির চেয়েও দ্রুত শক্তি বাড়িয়েছে, সেই প্রশ্ন তুলে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল রাওয়াত।
জেনারেল রাওয়াত বুধবার দিল্লিতে এক সেমিনারে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবেই পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশে মদত দিচ্ছে - আর সে কাজে তাদের সাহায্য করছে চীন।’ খবর-বিবিসি
বাংলাদেশ থেকে সুপরিকল্পিতভাবে এভাবে মুসলিমদের পাঠানোর ফলে আসামে যেখানে বছর কয়েক আগেও মাত্র পাঁচটি জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, এখন সে রাজ্যে আট থেকে নটি জেলা সে অবস্থায় চলে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমার তো মনে হয় না এখন আর সেখানে জনসংখ্যার ডায়নামিক্সে কোনও পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। আসামে যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, এই প্রবণতা (মুসলিমদের সংখ্যাবৃদ্ধি) সেখানে ঘটেই চলেছে’।
আর এই প্রসঙ্গেই তিনি টেনে আনেন আসামে মুসলিমদের রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত এআইইউডিএফ-এর জনপ্রিয়তাকে।
এ এআইইউডিএফ দলটি তৈরি হয়েছিল ২০০৫ সালে। এখন ভারতের পার্লামেন্টে তাদের তিনজন এমপি আছেন, আসামের বিধানসভাতেও ওই দল থেকে নির্বাচিত মোট ১৩জন বিধায়ক আছেন।
জেনারেল রাওয়াত বলেন, ‘এআইইউডিএফ বলে সেখানে একটা দল আছে। এরা কীভাবে শক্তিবৃদ্ধি করেছে যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন বিজেপির চেয়েও অনেক দ্রুত গতিতে তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।’
ভারতীয় সেনাবাহিনী সচরাচর দেশের রাজনৈতিক বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু ওই আলোচনাসভায় সেনাপ্রধান নিজে যেভাবে দুটি দলের নাম করে তাদের তুলনা করেছেন তা অনেককেই অবাক করেছে।
এআইডিইউএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও এমপি বদরুদ্দিন আজমল সেনাপ্রধানের মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে টুইট করেছেন, ‘শকিং! জেনারেল রাওয়াত তো রাজনৈতিক বিবৃতি দিচ্ছেন!’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দল যদি বিজেপির চেয়ে বেশি ফুলে ফেঁপে ওঠে, তাতে সেনাপ্রধানের কীসের মাথাব্যথা?’
‘বড় দলগুলোর কুশাসনের জন্যই এআইইউডিএফ বা আম আদমি পার্টির মতো বিকল্প দলগুলোর উত্থান হচ্ছে’, মন্তব্য করেছেন আজমল।
ভারতীয় সেনাবাহিনী অবশ্য এই বিতর্ক নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করেনি। তবে সেনা সূত্রগুলো বলার চেষ্টা করছে, জেনারেল রাওয়াতের মন্তব্যকে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাটা উচিত হবে না।
তাদের বক্তব্য, সেনাপ্রধান উত্তর-পূর্ব ভারতে অনুপ্রবেশের বিপদ নিয়ে সতর্ক করে দিতে গিয়েই ওই কথা বলেছিলেন।
সেমিনারে জেনারেল রাওয়াত আরও বলেন, ‘পাকিস্তান খুব পরিকল্পিতভাবে এই (বাংলাদেশী) অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। তারা সব সময় চায় এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করে ভারতের হাত থেকে তার নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে। এই খেলাটা তারা খুব ভাল খেলছে, আর সমর্থন পাচ্ছে উত্তর সীমান্তে চীন থেকে।’
কিন্তু সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে শুধু পাকিস্তান বা চীনকে আক্রমণ করাতেই থেমে থাকেননি - বরং দেশের ভেতরের রাজনৈতিক দলকেও টেনে এনেছেন - আর সমস্যা তৈরি হয়েছে সেখানেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন