চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি যত বাড়ছে, দেশটি ততই চেষ্টা করছে নিজেদেরকে বিশ্বমঞ্চের কেন্দ্রে বসাতে। একই সঙ্গে চেষ্টা করছে আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে, সেটা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সব দিকেই।
দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে চীন উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাবক এবং সামরিক সহায়তা প্রদানকারী দেশ। এখন হয়ে উঠছে কূটনৈতিক খেলোয়াড়। এ অঞ্চলের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিবাদ নিরসনে দেশটির ক্রমবর্ধমান ইচ্ছা দেখেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অতীতে চীন বৈশ্বিকভাবে নিজেদের আত্মকেন্দ্রীক হিসেবে দেখাত। তারা বলত, ‘চীন অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে, কিংবা অন্যের ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চায় না।’ এর ফলে মনে হতো, চীন হয়ত এমনটি করতে অক্ষম। আবার অনেক ক্ষেত্রে এমন না করায় তাদের স্বার্থ ভালো ভাবে রক্ষা করা যেত। এভাবে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার বিষয় এড়িয়ে যাওয়ায় চীন অনেক অন্যায্য শাসক, স্বৈরশাসকেরও বন্ধু হয়ে ওঠে।
কিন্তু এখন বিশ্ব জুড়ে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ বেড়েছে, ফলে অনেক বিষয়ই এড়িয়ে যাওয়া তাদের জন্য কঠিনই হয়ে উঠেছে। সত্যি বলতে কী, নিজের স্বার্থ রক্ষা এবং তা আরও বাড়িয়ে তুলতে দেশটিকে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা মোকাবিলায় জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় গত দুই বছরে চীন অনেকগুলো মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারত –পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমস্যা, এমনকি পাকিস্তান-আফগানিস্তান সমস্যার মধ্যেও নিজেদের জড়িয়েছে। মিয়ানমার ও তাদের জাতিগত বিদ্রোহীদের মধ্যকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে চীন।
ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সহযোগী বা অংশীদার চীন। পাশাপাশি এ অঞ্চলের অন্যদের সঙ্গেও সম্পর্ক বৃদ্ধি করে চলেছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ চীন। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশটি এরই মধ্যে এ অঞ্চলের অবকাঠামো খাতে অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে উঠে এসেছে।
এ মাসেই মালদ্বীপের সংকট সমাধানে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে চীন। এর বদলে দেশটির বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে। আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেছেন, ‘মালদ্বীপে যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে চীন সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে চায়।’
অবকাঠামো ও পর্যটন খাতে বিশাল বিনিয়োগের কারণে মালদ্বীপের অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা এখন চীনের।
গত বছর মিয়ানমারে চীন শুধু শান্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য অর্থই খরচ করেনি, বরং দেশটির জটিল জাতিগত দ্বন্দ্ব মেটাতে উদ্যোগ অব্যাহত রাখছে। এর আগে ২০১৬ সালে তিনটি বিদ্রোহী গ্রুপ- ন্যাশনাল ডেমোক্রোটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, ইউনিয়ন লিগ অব আরাকান আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মিকে সরকারের দ্বিবার্ষিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে বাধ্য করে।
একই সঙ্গে বিদ্রোহী সমর্থিত ফেডারেল পলিটিক্যাল নেগোশিয়েটিং অ্যান্ড কনসালটেটিভ কমিটি গঠনেও সহায়তা করে। এই কমিটি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছে।
মিয়ানমার অবশ্যই চীন ও ভারত উভয়েরই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও প্রতিবেশী। মিয়ানমারের কারণে চীন ভারত মহাসাগরে ঢুকতে পারে। এ ছাড়া চীনের কুনমিং থেকে কিয়াকপিউ পযন্ত গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন স্থাপিত হয়েছে। এখানে চীন গভীল সমুদ্রবন্দর ও একটি শিল্পাঞ্চল গড়ছে। মোটকথা মিয়ানমারে চীনই প্রধানতম বিনিয়োগকারী।
২০১৭ সালের এপ্রিলে চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়। সমাধানের পথ খুঁজতে দেশটির বিশেষ দূত সান গুওজিয়াং এরই মধ্যে দুই দেশ সফর করেছেন। বছর শেষে চীন সংকট সমাধানে তিন পদক্ষেপের পরিকল্পনা হাজির করে, পাশাপাশি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী দেওয়াও অব্যাহত রাখে।
চীন সড়ক ও বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়ে বাংলাদেশে তার উপস্থিতি শক্ত করছে। পাশাপাশি অস্ত্র সরবরাহের সম্পর্ক তো আছেই। ২০১৬ সালে শি জিনপিং ঢাকা সফর করেন, যা ছিল ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের সফর। ওই সময় ২৪ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের বিভিন্ন চুক্তিও সই হয়।
আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও সিপিইসি
আফগানিস্তানেও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এরই মধ্যে প্রবেশ করেছে চীন। আগে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের সঙ্গে একই সহযোগিতা গ্রুপে ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে পাকিস্তান-আফগানিস্তান উত্তেজনা মেটাতে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাবুল ও ইসলামাবাদ সফর করেন এবং একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। পাশাপাশি আলোচনার জন্য চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। গত ডিসেম্বরে এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আসলে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা রাখার ইচ্ছার ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছে।
এখন আফগানিস্তান আশা করছে, পাকিস্তান যেন তালেবানদের পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করতে না দেয় সেজন্য চীন ইসলামাবাদকে রাজি করাবে। আর পাকিস্তান আশা করছে, চীনের প্রতি আফগানিস্তানের অঙ্গীকারের কারণে সেখানে ভারতে প্রভাব কমবে। আর চীনের স্বার্থ হলো, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা থাকলে জিনজিয়াংয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারত এসব কর্মকাণ্ডের অনেকগুলোতেই প্রভাবিত না হয়ে থাকার সুযোগ নেই। দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তানের মাধ্যমেই এ অঞ্চলে ভারতকে সামলাচ্ছে চীন। এখন চীনের পরিকল্পনা আরও বড়, বিশ্বমঞ্চের কেন্দ্রে যেতে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ভারতকে দমিয়ে রাখা।
‘গঠনমূলক ভূমিকা’
দক্ষিণ এশিয়ার বড় খেলোয়াড় হিসেবে ভাবমূর্তি ধরে রাখতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতারও প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে চীন। গত জুলাই মাসে এক প্রশ্নের জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে উন্নয়নে চীন গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চায়।’ জম্মু ও কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখা ঘিরে চলমান ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ কথা বলেছিলেন।
ভারতকে নিয়ে চীনের দুই ভাবনা। প্রথমত, চীন নিজেকে একটা পর্যায় পর্যন্ত দাঙ্গাহাঙ্গামার ঊর্ধ্বে এবং বড় শক্তিধর বলে মনে করে, যে দেশটি এই অঞ্চলের সব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মিত্র ভারতকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অবশ্যই প্রতিটি ক্ষেত্রেই মোকাবিলা করতে হবে।
গত বছর গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত এক লেখায় বিশ্লেষক হু ওয়েইজা রোহিঙ্গা ইস্যু স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন, চীন দেশের বাইরেও সংঘাত মোকাবিলার সামর্থ অর্জন করেছে। আগের নাক না গলানোর নীতিতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বেইজিংকে বিদেশের মাটিতে তার প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকে রক্ষাও তো করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষেই চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের কারণে যে বিশাল বিনিয়োগ করছে, সেটিকে রক্ষা করার জন্য কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে আঞ্চলিক সব বিবাদ মেটাতে ভূমিকা রাখতে হবে।
চীনের নতুন এইসব কর্মকাণ্ড ভারতকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছে। অথচ এই দিল্লি অনেক দিন ধরে ভেবে এসেছে, তারা শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই প্রভাব রাখে না, এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোকেও নিরাপত্তা প্রদান কারে। কিন্তু এখন চীন এ অঞ্চলের ছোট দেশগুলোতেও ভারতের অভাবনীয় উপস্থিতির ক্ষেত্রে সমতা আনার প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি হতে চায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ও সহায়তার উৎস।
ভারত ভূখণ্ডের কারণে এ অঞ্চলে একক সুবিধা পায়। প্রতিবেশীদের কাছে ঋণ ও সহায়তা প্রদানকারীও হয়ে উঠেছে। তবু চীনের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। যেমন, ভারত নিজেই অস্ত্র আমদানিকারক, ফলে সামরিক সহায়তার মাধ্যমে বন্ধুদের মন জয় করার ক্ষেত্রে চীনের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে না।
এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত মনোজ জোশির লেখা থেকে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন