শামসুল আলম
‘এ্যাডভান্টেজ আসাম’ শীর্ষক বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগদানের আড়ালে দিল্লির সমর্থনের কনফার্মেশন আনতে ৫ দিনের ভারত সফরে গেলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। নামেই বোঝা যাচ্ছে এটা ঐ রাজ্যের বিনিয়োগ সংক্রান্ত সম্মেলন। রাষ্ট্রপতির সফরটি আসাম দিয়ে শুরু হলেও নানা গড়বড় ও অসম্মানক ঘটনা ঘটতে থাকে একের পর এক!
১) শুরুতেই প্রটোকলে বা রাষ্ট্রাচারে বিরাট উল্টাপাল্টা ঘটায় আসাম সরকার। এডভোকেট আবদুল হামিদ একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া স্বত্ত্বেও তাকে প্রটোকল দেয়া হলো মুখ্যমন্ত্রীর মর্যাদার। বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি হামিদকে স্বাগত জানান আসামের গভর্নর জগদীশ মুখী। অথচ সেখানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল ভারতের রাষ্ট্রপতির, অথবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, নূন্যতম পক্ষে মূখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়ালের। কিন্তু এর একটাও না করে বিমানবন্দরে রাজ্যের গভর্নর পাঠানোর অর্থ পরিস্কার- আবদুল হামিদকে তারা কোনো স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি মনে করেন না! অবশ্য বিতর্ক বেশি ওঠায় রাষ্ট্রপতি হামিদকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ।
২) একই ঘটনা ঘটলো গতকাল শেখ হাসিনার সিঙ্গাপুর সফরে/ভ্রমনে। সেখানেও শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান সে দেশের একজন প্রতিমন্ত্রী ডক্টর আমি খোর। অথচ রাষ্ট্রীয় বা সরকারী সফর হলে রেওয়াজ আছে আমন্ত্রিত প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাবে স্বাগতিক দেশের প্রধানমন্ত্রী। এর মানে কি বাংলাদেশের অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফরে গেলে কেহই মর্যাদা দিতে চাননা। অবশ্য গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, এটি সিঙ্গাপুর সফরের আড়ালে মুলত চীনের অনুকম্পা লাভের উদ্দেশ্যে তাদের সাথে গোপন বৈঠক করাই হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য!
৩) আসি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ইস্যুতে। আসাম সফরে রাষ্ট্রপতিকে রাখা হয় আসামের পাঁচ তারকা হোটেল ভিয়াস্তায়। তাঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতে আসেন বিজেপি নেতা আসামের মূখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল। এ বৈঠক নিয়ে বিরাট বিতর্ক শুরু হয়েছে। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের জন্য ভেন্যুতে পৌঁছে মূখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালের জন্য দলবল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। ১০ মিনিট অপেক্ষার পর সনোয়াল আসেন এবং বৈঠক শুরু হয়। যেখানে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মহামান্য অতিথির জন্য মূখ্যমন্ত্রীর অপেক্ষা করার কথা; সেখানো উল্টো বন্ধু রাষ্ট্রের অতিথি প্রেসিডেন্ট অপেক্ষা করেন একজন মন্ত্রী মর্যাদার মূখ্যমন্ত্রীর জন্য! হায়রে বন্ধুত্ব, নাকি দাসত্ব! প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রধান এবং এক নম্বর নাগরিক। সাংবিধানিকভাবে তিনি হলেন রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যাক্তি, সে জন্যই প্রেসিডেন্ট নাম উচ্চারণের আগে ‘মহামান্য’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রির জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে অপেক্ষা করতে থাকা- কেবল অপমানজনকই নয়, রীতিমত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে অস্বীকার করার নামান্তর।
৪) একজন মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ১০ মিনিট বসিয়ে রাখা নিঃসন্দেহে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বিবর্জিত কাজ। বর্তমান সরকারের আগে অতীতে কখনও এরূপ প্রটোকল বিপর্যয়ের কথা শোনা যায়নি। সাধারণ নাগরিকেরও এটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে, এদেশের বর্তমান সরকার মেরুদন্ড ভারতের কাছে এমন ভাবে বন্ধক দিয়েছে যে, ভারতের আসাম রাজ্যের একজন মূখ্যমন্ত্রীও ‘আমাদের প্রেসিডেন্টকে শিষ্টাচার দেখানোর মতো যোগ্য মনে করেন না’! মনে পড়ে যায়, সিকিমের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার পর লেন্দুপ দরজির অবস্থা এরকম হয়েছিল!
৫) এসব অকান্ড ছাড়াও আসামে থাকার সময় হোটেলের সামনেই আব্দুল হামিদের কুশপুত্তলিকা দাহ্য করেছে হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠন, তাও পুলিশের সামনেই। বাংলাদেশে বিদেশী মেহমান এলে এমন অকান্ড করতে দিত কি?
৬) প্রতিবেশী এ মোড়ল দেশটি আমাদের সাথে আরও কি করছে, একটু দেখা যাক। ৫ দিনের সফরে ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ ভারত যান। সফরের সময় তাঁকে আগ্রার তাজমহল দেখানোর জন্য নেয়া হয়। আগ্রায় যে হোটেলে রাষ্ট্রপতিকে রাখা হয়, সেখানে লিফট ছিল ঝুকিপূর্ণ। তাজমহল দেখানোর জন্য নেয়া হয় ব্যাটারিচালিত একটি সাধারণ পরিবহনে। রাষ্ট্রপতি হামিদের আজমির শরীফ জিয়ারতের সময় সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার এনিয়ে ফলাও করে খবর প্রচার করে।
৬) আমাদের রাষ্ট্রপতিকে যখন এভাবে অপমান অপদস্ত করে ভারত, তখন আমরা তাদের সাথে কি করছি, একটু দেখা যাক। গত জানুয়ারী মাসে ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে’ যোগদান করতে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফরে আসেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট হওয়া স্বত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান (অর্থাৎ সার্ভিং রাষ্ট্রপতির প্রটোকল) জানায়। বাংলাদেশের জনগণ প্রণব মুখার্জীকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন; নিজেরাও সম্মানিত হয়েছেন! কেননা প্রবণ মুখার্জী বাংলাদেশের জামাই, তাছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের প্রধানতম আন্তর্জাতিক মুরব্বী। মুলত, তাঁর বদান্যতায় শেখ হাসিনার বিনা ভোটের সরকার এখনও টিকে আছে!
কিন্তু প্রণব বাবু চলে যাওয়ার পর জনগণের দৃষ্টিতে আটকে যায় একটি ছবিতে- যাতে দেখা যায় ভারতীয় দূতাবাস আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জী চেয়ারে আয়েশ করে অসে আছেন, তার তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (যিনি প্রণবের চাইতেও জ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ) সহ সংসদের স্পীকার ও কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী। ছবির মর্মার্থ এমন দাড়ায় যে, প্রভু বসে আছেন, আর অতি উৎসাহী চামচারা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ছবিটি প্রকাশ হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। পরে বিতর্কের মুখে তা প্রত্যাহার করে নেয় ভারতীয় দূতাবাস। এমনকি তখন ভারতীয় মিডিয়াতে পরামর্শ দেয় হয়, বাংলাদেশের সাথে আচার ব্যবহারে ভারত যেনো সতর্ক থাকে।
তাহলে কি দেখা গেলো? আমরা কি করি, আর ওরা কি করে! এর নাম কি বন্ধুত্ব, নাকি অধীনতামূলক মিত্রতা?
কথা শেষ হয়নি। আসামে গিয়ে শুরুতে রাষ্ট্রপতি হামিদ আসামের কামাখ্যা মন্দির পরিদর্শন করেছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে অবস্থিত বিখ্যাত এই মন্দিরে যান। এটা ঠিক যে, রাষ্ট্রীয় সফরে গেলে রাষ্ট্রপতি/সরকার প্রধান অনেক ক্ষেত্রে সেখানে অবস্থিত নিজ ধর্মীয় প্রার্থনাগার পরিদর্শন করেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিও গিয়েছিলেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। কিন্তু আবদুল হামিদ আসামে গিয়ে মায়া যাদু ও উলঙ্গপনার জন্য বিখ্যাত ‘কামাখ্যা মন্দির’ পরিদর্শনে গেলেন কোন্ বিবেচনায়? উনি কি স্বধর্ম ত্যাগ করেছেন? নাকি দাদারা খুশি হবেন, তাই? অথবা আওয়ামীলীগের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কোনো যাদুমন্ত্র আনতে গিয়েছেন?
শিষ্টাচার বা প্রটোকল বলতে একটা বিষয় আছে, সেটা কি পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অফিসাররা আজকাল ভুলে গেছেন? নাকি বাংলাদেশের মান মর্যাদা নামাতে নামাতে এরা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে চান? আমি নিজে প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার ছিলাম এক টার্ম, বেশ কয়েক ডজন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও বিদেশে বহু রাষ্ট্রীয় সফরও করেছি। ঐসব অভ্যর্থনা ও প্রটোকলের বিষয়ে আমরা কোনো কম্প্রোমাইজ করতাম না। স্বাভাবিকের নীচের কোনো রাষ্ট্রচার আমরা গ্রহন করতাম না। দরকার হলে সফর বাতিল করা হতো।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে এভাবে অসম্মানিত হবেন, দেশের মর্যাদাহানি করবেন- তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এখন তোলপাড় চলছে। আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক তুঙ্গে। কেউ কেউ দুঃখ করে বলছেন, ‘ভারত বন্ধু এবং বড় দেশ ঠিক আছে। কিন্তু আমরাও মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি। বন্ধুত্বের নিদর্শন রাখতে গিয়ে ভারতের তাবেদারী করে নিজেদের আর কত নীচে নামতে হবে?’ অধঃপতন দেখে অনেকেই বলছেন, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের লজ্জা হয়! জাতীয় গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হয়েছে- ‘মহামান্য’ আমরা আর কত নিচে নামব?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন