মায়ের আগেই দুনিয়া ছেড়েছে প্রাণপ্রিয় সন্তান। এখন শুধু তার লাশটা চান মা মনিকা পারভীন (৫৫)। সে কারণে সুদুর খুলনার রুপসা উপজেলার আইজগাতি গ্রাম থেকে ছুটে এসেছেন রাজধানীতে।
১৯ মার্চ, সোমবার হাজির হন আর্মি স্টেডিয়ামে। যেখানে হাজির করা হয়েছিল নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ২৩ জনের মরদেহ।
গত ১২ মার্চ, দেশটির ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তে নিহতদের তালিকায় ছিলেন খুলনার বিএল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স পড়ুয়া আলিফুজ্জামানও। কিন্তু তার লাশ এখনো শনাক্ত করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ কারণে বিপাকে পড়েছেন নিহতের পরিবার।
মায়ের মন বলে কথা। যদি ২৩ লাশের সাথে তার ছেলে লাশ আসে। এই আশাতেই ছুটে এসেছিলেন তিনি। ঘড়ির কাটায় তখন বিকেল চারটা। আর্মি স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি। মুখে নেকাব। সঙ্গে দাড়িয়ে আছেন তার ছোট ছেলে ইয়াসিন আরাফাতও। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে গণমাধ্যম কর্মীদের চোখ তখনো পড়েনি। আলিফুজ্জামানের মা ও ভাইকে দেখে ছুটে যান এই প্রতিবেদক। কথা হয় তাদের সঙ্গে।
ছেলেকে হারিয়ে মা মনিকা পারভীন পাগল প্রায়। বারবার কান্না করছেন আর পরনের কাপড়ে চোখের পানি মুছছেন। জানতে চাইলে মনিকা পারভীন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ও খুব চালাক ছিল। বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতো। মাঝে মাঝে ভারত গেলে বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে আসতো।’
বিমানে ওঠার আগে সেলফি তোলেন আলিফুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত
মোল্লা আলিমুজ্জামান ছিলেন পরোপকারী। গ্রামে কারও কোনো সমস্যা হলেই ছুটে যেতেন। এ কারণে গ্রামের সবার মধ্যমণি ছিলেন তিনি বলে জানালেন তার মা মনিকা পারভীন। সেই ছেলে তাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন সেটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন তিনি।
নেপালে দুর্ঘটনায় নিহত ছেলের লাশটা যেন তিনি অন্তত হাতে পান তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতো। প্রধানমন্ত্রী যেন আমার ছেলের লাশটা শনাক্ত করে দ্রুত দেশে আনার ব্যবস্থা করে দেন।’
নেপালে রওনার আগে যশোর বিমানে করে ঢাকায় এসে পৌঁছেছিলেন আলিফুজ্জামান। মাকে জানিয়েছিলেন, বন্ধুদের সঙ্গে চারদিনের সফরে তিনি নেপাল বেড়াতে যাচ্ছেন। চারদিন পরই আবার দেশে ফিরবেন। কিন্তু এখনো আর ফেরা হয়নি তার। হয়তো ফিরবেন তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে। সেদিন দেখবেন না তার মাকে। কথাও হবে না তার সঙ্গে। শুধু কান্নাই হবে শেষ কথোপকথন।
ইউএস বাংলার বিমানে উঠে শেষ কথা হয়েছিল ছোট ভাই ইয়াসিন আরাফাতের সঙ্গে। সেই সময় ফোনে আলিফুজ্জামান আরাফাতকে বলেছিলেন- ‘নেপাল যাচ্ছি। বিমানে উঠেছি। নেপালে পৌঁছে ভিডিও কলে তোর সাথে কথা হবে।’ কিন্তু আর কথা হয়নি। দেখাও হয়নি। আর কোনদিন দেখাও হবে কি না জানেন না তার ছোট ভাই আরাফাত।
তবে বিমানে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনের শেষ স্টাটাস দিয়েছিলেন তিনি। তাতে আলিফুজ্জামান লিখেছিলেন- ‘গুড বাই যশোর, গুড বাই ঢাকা।’
আলিফুজ্জামানের ছোট ভাই ইয়াসিন আরাফাত জানান, তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজ ছিলেন আলিফ। তিনি খুলনার বিএল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স পড়তেন। স্বপ্ন ছিল পড়াশুনা শেষ করেই চাকরি করবেন। তবে ভ্রমণের নেশা থেকেই তার ভাই নেপালে গিয়েছিল বলে জানান তিনি।
বিকেলে যখন নিহতের স্বজনরা তাদের মরদেহগুলো বুঝে নিয়ে দাফনের উদ্দেশ্যে নিজ গন্তব্যে রওনা হচ্ছিলেন তখনও স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন মা মনিকা পারভীন ও তার ছেলে ইয়াসিন আরাফাত।
সে সময় বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী শাহজাহান কামালকে দেখেই তার গাড়ির কাছে ছুটে যান মা। তার কাছেও আকুল আবেদন জানান ছেলের লাশ শনাক্ত করে দেশে ফেরত আনার জন্য। অবশ্য মন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করেন।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন