ঘুরে ফিরে সব কিছু ছাপিয়ে বারবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্ট বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলা ও জামিন ইস্যুতেও এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে গত কয়েক মাসে বড় দু’টি ঘটনায় আলোচনা ও বিতর্কের বিষয় ছিল সুপ্রিম কোর্ট। তারমধ্যে একটি- সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা কেন্দ্রীক। অপরটি হচ্ছে- বিচারপতি আবদুল ওহ্হাব মিঞার পদত্যাগ। যদিও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গত দেড় মাসেও তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা না করা নিয়ে কোনো কিছুই জানা যায়নি। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়োগ দেয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার পদত্যাগের ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। তিনি কোর্টও করছেন না। এখন নতুন করে খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে ঘিরে। এ বিতর্ক কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।
খালেদা জিয়ার মামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রথমে জামিন আবেদন করা হলে মামলার নথি তলব করা হয়। যদিও নথি ছাড়া আসামিকে জামিন দেয়ার ক্ষমতা ও অহরহ নিয়ম চালু আছে হাইকোর্টে। যা আদালতও এ মামলার শুনানিকালে বলেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে নথি না পাওয়া পর্যন্ত জামিন আদেশ স্থগিত রাখা হয়। নথি তলবের এই বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা অনেকেই অবাক হয়েছেন। এর পর ১২ মার্চ শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট চার মাসের জামিন দিলেও সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি আটকে যায়। অবশ্য এর আগে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের জামিন ঠেকাতে চেম্বার জজ আদালতে যায়। চেম্বার জজ অন্য মামলার ক্ষেত্রে এমন আবেদন নিষ্পত্তি করলেও খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন নিষ্পত্তি করার জন্য পাঠানো হয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, চেম্বার জজ জামিন স্থগিত না করলে প্রধান বিচারপতি স্থাগিতাদেশ দেয়ার নজির সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু খালেদা জিয়ার মামলা- যেটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। সরকার বারবার বলছে- এই মামলায় তারা কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জামিনে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।
আইনজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো মামলায় প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার আছে জামিন দেয়া বা স্থগিত করার। এ ক্ষেত্রে তার জবাবদিহিতার প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগও নেই। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও সেই বিষয়ে একমত। কিন্তু নি¤œ আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত যেকোনো মামলায় উভয় পক্ষকে শুনানি করার সুযোগ দেন। এর পর বিচারক যেটা সঠিক মনে করেন সেই সিদ্ধান্ত দেন। তবে সুপ্রিম কোর্টে খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতাদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে চিরাচরিত এ নিয়মের ব্যাতিক্রম হয়েছে। এ নিয়ে আদালতে তাৎক্ষণিক আসামি পক্ষের আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণও করেন। কিন্তু ফল হয়নি। বরং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘আপনারা কি থ্রেট দিচ্ছেন? থ্রেট দিবেন না।’ এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্টের অনেক সিনিয়র আইনজীবী, সাবেক কয়েকজন বিচারপতি ও বিএনপি নেতাকর্মীসহ খালেদা জিয়ার কোটি কোটি সমর্থক।
তবে আসামিপক্ষ বলছে, ‘এটা বলে প্রকারন্তরে তাদেরকেই উল্টো থ্রেট করা হয়েছে।’ বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। ওই দিনই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ‘একপেষে ও পক্ষপাত’ আচরণের অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্ট চত্ত্বরে তার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন আইনজীবীরা। কিন্তু প্রধান বিচারপতি যদি আসামিপক্ষের বক্তব্য শুনতেন তাহলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না, কোনো বিতর্ক থাকতো না বলেই মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বরাবর একজন ‘নরমপন্থী’ বিচারক হিসেবে পরিচিত। তার রেগে যাওয়া বা হঠাৎ উত্তেজিত আচরণ করার তেমন কোনো নজির নেই। শান্ত প্রকৃতির বিচারপতি হিসেবে তার বেশ সুনামও রয়েছে। তবে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতাদেশ দেয়ার সময়। তার চিরাচরিত নিয়মের বিপরীতে যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির আইনজীবীদের কোনো ভুল ছিল কিনা তাও জানতে চাচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তবে দেশের সাধারণ মানুষের মনে এখন নানা প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- তাহলে খালেদা জিয়ার এখন কী হবে? তিনি কি জামিন পাবেন না? পেলে কবে কারাগার থেকে বের হতে পারবেন? খালেদা জিয়া মুক্তি না পেলে কী হতে পারে? সরকারের পক্ষ থেকে শ্যোন অ্যারেস্ট না দেখানোর কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কুমিল্লার নাশকতা মামলায় সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। এবার আইনমন্ত্রী বলছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট জামিন দিলেও খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। কারণ কুমিল্লার মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।’ তাহলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই কি ক্ষমতাসীনরা নির্বাচন করতে চাচ্ছে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ একাধিক মন্ত্রী যেমনটি বলছেন, ‘কারো জন্য নির্বাচন থেমে থাকবে না।’ এমনকি ওবায়দুল কাদের আরও খোলাসা করে বলে ফেলেছেন, ‘পুনরায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা আনুষ্ঠানিকতা বাকি।’ তার মানে, ২০১৪ সালের মতো যেকোনোভাবেই হোক আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় থাকবে সেটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি? এমন প্রশ্ন এখন শুধু রাজনৈতিক মহলে নয়, সাধারণ মানুষের মুখেও।
এদিকে, রাজনৈতিক মহলে বেশকিছু দিন ধরে ঘুরে ফিরে একটি গুঞ্জন চলছে। বিএনপিকে সমঝোতায় আনতে চায় আওয়ামী লীগ। ঠিক ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের মতো। কিন্তু ওই সময় বিএনপি সমঝোতায় রাজি না হওয়ায় সুবিধা লুটেছে এরশাদের জাতীয় পার্টি, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ অন্যরা। ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন হলেও ঠিকই চার বছর এরই মধ্যে পার করেছে আওয়ামী লীগ। এবং সরকারের পাঁচ বছর পূর্ণ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অনেকে বলছেন, এবারও এমন একটা পদ্ধতিতে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য বিএনপিকে অবশ্য সংসদীয় বিরোধী দলে রাখতে চায় দলটি। যাতে বিতর্ক থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং ক্ষমতাও শক্তিশালী হয়।
গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, এ জন্য কারাবন্দী খালেদা জিয়ার কাছে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এমনকি মামলার রায়ের আগেও এমন সমঝোতার প্রস্তাব ছিল বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে ৮০ থেকে ১০০ আসন দেয়ার প্রস্তাবের কথাও শোনা যায়। যদিও কোনো পক্ষই তা স্বীকার করছে না। বিএনপির শীর্ষ নেতারা এমন গুঞ্জনকে একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছেন। দলটির শীর্ষ একজন নেতা বলেছেন, ‘এমন প্রস্তাবের প্রশ্নই উঠে না। কারণ বিএনপি তো বিরোধী দলেই আছে। এ জন্য সমঝোতার প্রয়োজন কি? দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে এমন প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই।’ আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতা হচ্ছে না।’ এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও একাধিকবার বলেছেন, ‘সরকারের দায়িত্ব নয় কোনো দলকে নির্বাচনে আনতে সাধাসাধি করা। কোন দল নির্বাচন করবে বা করবে না, সেটা তাদের দলের ব্যাপার। সরকারের পক্ষ থেকে এ জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে না।’ নির্বাচন নিয়ে ‘কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না’ বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তারপরও থেমে নেই গুঞ্জনের ডালপালা।
তবে এ সবের মধ্যে ১৬ মার্চ হঠাৎ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার উন্নয়নে-অর্জনে জনগণ খুশি। নির্বাচনে বিজয় একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।’ তার এই বক্তব্যকে অনেকেই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন।
খালেদা জিয়ার মামলার সর্বশেষ অবস্থা কী?
গত ১৮ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের পৃথক লিভ টু আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শেষে আদেশের জন্য ধার্য করা হয় ১৯ মার্চ। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের দাবি, রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। হাইকোর্ট বেগম জিয়াকে চার যুক্তিতে জামিন দিয়েছেন। যদিও আইনজীবীরা বলছেন- সুপ্রিম কোর্টেও খালেদা জিয়া জামিন পাবেন। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, প্রথম দিনেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন যে আচরণ দেখিয়েছেন তাতে লক্ষণ ভালো দেখা যাচ্ছে না। তবে এভাবে খালেদা জিয়ার জামিন আটকে রাখা হলে বিচার বিভাগের জন্য তা খারাপ নজির সৃষ্টি করবে। এর কারণ, অধিকাংশই মনে করছেন, বিচার বিভাগ অন্য কারো আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছেন।
১৪ মার্চ আদালতে যা ঘটেছিল
১৪ মার্চ সকাল ৯টার পর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত চেয়ে করা ২টি আবেদনের ওপর শুনানি শেষে জামিন স্থাগিতাদেশ দেন। জামিন শুনানিকালে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের জবাবে ‘আদালত পাবলিক পারসেপশনের দিকে তাকায় না’ বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত আবেদনের শুনানির শুরুতেই দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘হাইকোর্ট চারটি কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়াকে জামিন দিয়েছেন। আমরা এখনো সে আদেশের সার্টিফায়েড কপি পাইনি। আদেশের কপি পেলে লিভ টু আপিল করব।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সিপি ফাইল করে আসেন।’ তখন দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘সিপি ফাইল করতে রোববার-সোমবার পর্যন্ত আমাদেরকে সময় দেয়া হোক। এ পর্যন্ত জামিন স্থগিত রাখা হোক।’
এর পর আদালত বলেন, ঠিক আছে সিপি ফাইল করে আসেন রোববারের মধ্যে। এ পর্যন্ত ‘জামিন স্টে’ থাকবে।
তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য তো শুনেন নাই। আমাদের বক্তব্য না শুনে এভাবে আদেশ দিতে পারেন না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘শুনতে হবে না। রোববার পর্যন্ত তো স্থগিত দিয়েছি। ওই দিন আসেন তখন শুনব।’
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আপনি যে একতরফাভাবে শুনানি করে আদেশ দিলেন, আদালতের প্রতি পাবলিক পারসেপশন খারাপ হবে।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমরা পাবলিক পারসেপশনের দিকে তাকাই না। কোর্টকে কোর্টের মতো চলতে দিন।’
এরপর জয়নুল আবেদীন ও এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘না শুনেই তো আদেশ দিলেন।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা অন্তবর্তীকালীন আদেশ দিয়েছি। আমাদের শোনার দরকার নেই।’ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এই মামলায় চেম্বার আদালত তো স্টে দেয়নি। এই সময়ের মধ্যে আসামিও বের হবে না। তাই স্টে’র প্রয়োজন নেই।’ এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা তো শুনানির সুযোগ পেলাম না।’ এর পরই কার্যতালিকা থেকে অন্য মামলা শুনানির জন্য তোলা হয়। তখন খালেদা জিয়ার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন আহমদ দাঁড়িয়ে আদালতকে বলেন, ‘আপনি তো না শুনেই একতরফা আদেশ দিলেন। আমাদের কথা শুনতে হবে। কেন শুনবেন না।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কার কথা শুনবো, কার কথা শুনবো না- তা কি আপনার কাছে শুনতে হবে?’ গিয়াস উদ্দিন আবারো একটু উত্তেজিত হয়ে একই কথা বললে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কি আদালতকে থ্রেট করছেন?’ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘শুনে তারপর আদেশ দিতে হবে।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘থ্রেট দিবেন না।’
শুনানির একপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আপনি তো কোর্টকে শেষ করে দিলেন।’ তখন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় একদল আইনজীবী ‘দালাল’ ‘দালাল’ বলে আদালত কক্ষ ত্যাগ করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করে আদালতের আদেশের পরে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জয়নুল আবেদীন অ্যাসোসিয়েশনে সভাপতির কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘অতীতে আদালত কখনোই এ ধরনের আদেশ দেননি।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের আদেশের নজির নেই, এ আদেশ নজিরবিহীন। আসামিপক্ষের আবেদন না শুনে কখনো কোনো প্রধান বিচারপতি এ ধরনের রায় দেননি। এ রায়ে আমরা মর্মাহত, আমরা ব্যথিত।’ সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি বলেন, আদালতে সিনিয়র আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। আমরা আদালতকে অনুরোধ করেছিলাম, আমাদের কথা শুনতে। কিন্তু আদালত শুনেনি।
সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আমাদের কথা শোনার জন্য আদালতকে বলেছিলাম। কিন্তু আদালত বলেন, আমরা কার কথা শুনবো না শুনবো তা আমাদের ব্যাপার।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে কোনো প্রধান বিচাপতি আসামিপক্ষের কথা না শুনে রায় দেননি। এবারের ঘটনা নজিরবিহীন।’
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ
খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতের আবেদনের শুনানিকালে বক্তব্য না শুনায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। ১৪ মার্চ সকাল ১০টার দিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে তারা এ বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভে আইজনীবীরা প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেন। এ সময় তারা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও জানান।
কুমিল্লায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ
একই দিন অর্থাৎ ১৪ মার্চ, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাসে পেট্রলবোমা বিস্ফোরণ করে ৮জন হত্যা মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ও জামিন আবেদন খারিজ করেছেন আদালত। কুমিল্লার ৫নং আমলী আদালতের বিচারক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাকিন বিল্লাহ জামিন আবেদন খারিজ করে দেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুস সাদাত জানান, ‘আমরা খালেদা জিয়ার পক্ষে আবেদন করেছিলাম। আদালত শুনানি শেষে ২৮ মার্চ তাকে কুমিল্লার আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’
যে ৪ যুক্তিতে হাইকোর্টে জামিন
১২ মার্চ সোমবার, চারটি যুক্তি গ্রহণ করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন মঞ্জুর করে তাকে চার মাসের জামিন দেন। এ জন্য কোন চারটি যুক্তি গ্রহণ করা হয়েছে তাও জানান আদালত। যুক্তিগুলো হলো-
প্রথমত, এই মামলায় খালেদা জিয়াকে সংক্ষিপ্ত সাজা দেয়া হয়েছে, সাধারণত ৭ বছরের কম মেয়াদের সাজা হলে জামিন পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, মামলাটি শুরু থেকেই মোকাবিলা করে আসছেন খালেদা জিয়া। তৃতীয়ত, শুরু থেকেই তিনি জামিনে ছিলেন এবং
চতুর্থত, তিনি ৭৩ বছর বয়সে নানা রোগে আক্রান্ত।
নির্বাচন নয়, দৃষ্টি সুপ্রিম কোর্টে
বলা হচ্ছে, ২০১৮ সাল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। হিসাব অনুযায়ী ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার কথা। সরকার ও নির্বাচন কমিশনও ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন করার কথা বলছে। সেই হিসাবে নির্বাচনের বাকি মাত্র ৯ মাস। এমনকি খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই জুন-জুলাইয়ের মধ্যে সরকার আগাম নির্বাচন করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। জুন-জুলাই বা ডিসেম্বর- যাইহোক, নির্বাচনের বছর এটি। কিন্তু এ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং সবার মুখে মুখে খালেদা জিয়া। তার জামিন, মুক্তি এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারা না পারা এখন আলোচনার প্রধান ইস্যু। সেই সাথে দেশবাসীর দৃষ্টি সুপ্রিম কোর্টে। কারণ, সবকিছু নির্ভর করছে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের ওপর।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আর দেখতে চান না দেশবাসী। জনগণ চান, ভোট দিয়ে সংসদে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি পাঠাতে। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে না থাকলে সেটা সম্ভব নয়। আর বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়া- না নেয়ার নিয়ামক দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারের আচরণ। বিএনপিসহ অনেকেই মনে করেন, সরকার যদি না চায় বিএনপি নির্বাচনে আসুক, তাহলে যেকোনোভাবেই হোক খালেদা জিয়ার মামলায় সরকার প্রভাব বিস্তার অব্যাহত রাখবে। সেক্ষেত্রে তার মুক্তি পাওয়া ও নির্বাচনে অংশ নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে বর্তমান পরিস্থিতি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ও মিত্র দেশগুলোও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, প্রতিবেশী দেশ- ভারতসহ সব গণতান্ত্রিক দেশ ও বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট দেশগুলো- বলা যায় সবাই বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং উৎসবমুখর নির্বাচন দেখতে চায়। বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটকে বাদ দিয়ে যেটা ভাবা যায় না। সুতরাং দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং রাজনীতির ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার মামলার ওপর। যা দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। তাই, এখন নির্বাচন নয়, বরং দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জনগণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেরও দৃষ্টি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে। যতদিন খালেদা জিয়ার জামিন ও মুক্তি নিয়ে ধোঁয়াসা দূর না হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসনের অংশ নিতে পারা না পারার বিষয়ে আদালত থেকে নির্দেশনা আসছে, ততদিনে সবার দৃষ্টি আদালতেই থাকবে। আলোচনার কেন্দ্রেও থাকছে সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও আইনবিদদের মতে, অবস্থাদৃষ্টে দ্রুতই খালেদা জিয়ার মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তার মুক্তিও সহসা হচ্ছে না। আর বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার মূলত ৫ জানুয়ারি মার্কা আরেকটি নির্বাচন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ জন্য ৭৩ বছরের একজন বয়বৃদ্ধ নারী, দেশের তিনবারের সফল প্রধানমন্ত্রী, দুবারের সংসদীয় বিরোধী দলের নেতা, দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন এবং ২০ দলীয় জোট প্রধানকে ‘বানোয়াট ও মিথ্যা’ মামলায় দ- দিয়ে নির্জন কারাগারে আটকে রেখেছে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে আটকে রেখে সরকারের সেই ‘দিবাস্বপ্ন’ পুরণ হবে না। তারা বলছেন, এ দেশের মানুষ খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে ছাড়া একতরফা কোনো নির্বাচন আর হতে দেবে না, হতে দেয়া হবে না। সেই সাথে আদালতের ওপর সরকার প্রভাব বিস্তার করছে বলেও বরাবরই অভিযোগ করে আসছে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। নি¤œ আদালতে খালেদা জিয়ার মামলার রায়, হাইকোর্টে তার জামিন শুনানি, সুপ্রিম কোর্টে জামিন স্থগিত, লিভ টু আপিল শুনানি ও আদেশের ক্ষেত্রে তার প্রতিফল হচ্ছে বলেও দাবি করছেন বিএনপির শীর্ষনেতা ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হচ্ছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে এ বিতর্কের শেষ কোথায়- সেটাই দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ। দেশবাসী চান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক দেশে। সব বিতর্ক দূর হয়ে সবার অংশগ্রহণে ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হোন জনপ্রিতিনিধিরা। ফিরে আসুক সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশ। দূর হোক অস্থিরতা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন