আন্দোলনের জন্য কর্মীদের চাপের পাশাপাশি সিনিয়র নেতাদের তেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত্ম নেয়ার জন্য বৈঠক ডাকা হলেও নানা অজুহাতে অনেকে তাতে যোগ দিচ্ছেন না
হাসান মোলস্না
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় বিএনপিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মুক্তি বিলম্বিত হওয়ার জন্য আইনজীবীদের ভুলের বিষয়টি সামনে আসাসহ কয়েকটি কারণে আইনজীবীদের মধ্যে একরকম বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনের বিষয়ে এখনই একটা সিদ্ধান্ত্ম নেয়ার ইসুকে কেন্দ্র করে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে মনোমালিন্য আছে। আর যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালিত হওয়ায় এক ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। সিনিয়র নেতাদের কেউ আলোচনার মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার আহ্বান জানাচ্ছেন, আবার কেউ কঠোর হওয়ার হুশিয়ারি দিচ্ছেন।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছর সাজা হওয়ায় গত ৮ ফেব্রম্নয়ারি থেকে কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। হাইকোর্ট জামিন দিলেও গত সোমবার সুপ্রিম কোর্ট আগামী ৮ মে পর্যন্ত্ম জামিন স্থগিত করে দেয়। ফলে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত্ম খালেদা জিয়া জামিন নাও পেতে পারেন, এমন ধারণা বিএনপির পাশাপাশি জনমনেও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত্ম বিএনপিসহ সমাজের বড় অংশই মনে করত, খালেদা জিয়া খুব কম সময়ের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে আসবেন। বিএনপির মধ্যেও এমন আশা ছিল। গত সোমবার থেকে সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়। আর খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত হওয়ায় দল ও জোটে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। বিশেষ করে মুক্তি বিলম্বিত হওয়ার জন্য নেতারা আইনজীবীদের দায়ী করছেন। এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। নিয়োগ করা হয়েছে বিদেশি আইনজীবীও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিলম্বিত হওয়ার পেছনে আইনজীবীদের কী কী ভুল ছিল তা দলের পক্ষ থেকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সামনে আসা দুটি বিষয় হচ্ছে- এক. জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন না করার পাশাপাশি বেশকিছু ক্ষেত্রে ভুল সংশোধন না করেই আদালতে খালেদা জিয়ার জবানবন্দি জমা দেয়া। দুই. সাজা হওয়ার আগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া মামলাগুলোতে জামিন নেয়ার পরামর্শও দেননি আইনজীবীরা। ফলে কারাগারে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার দেখানোর মতো আইনি পঁ্যাচে পড়তে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। এ অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আইনজীবীদের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
বিএনপি সূত্র মতে, আইনজীবীদের মধ্যে মতবিরোধের বিষয়টি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জানতে পেরেছেন। এ জন্য মামলা পরিচালনায় প্রধান ভূমিকায় আইনজীবী এজে মোহম্মদ আলীকে রাখার নির্দেশ দেন তিনি। এ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি অন্য বেশ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী। ফলে আদালতে খালেদা জিয়ার জামিন কার্যক্রমের সময় সিনিয়র অনেক আইনজীবী চুপ করে বসে ছিলেন। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরম্নদ্ধে মামলায় আইনি পরামর্শক হিসেবে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টিও অনেক আইনজীবী ভালোভাবে নেননি। তবে প্রকাশ্যে কেউ কোনো কথা না বললেও ঘরোয়াভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের প্যানেল দল থেকে ঠিক করে দেয়া হলেও ভেতরে ভেতরে থাকা অসন্ত্মোষ নিষ্পত্তি করা যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খালেদা জিয়ার এক আইনজীবী বলেন, সহসা তো নয়ই, নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। আর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ও তারেক রহমানের বিপক্ষে যেতে পারে। বিএনপি ও জিয়া পরিবারের বর্তমান দুর্দিনের পেছনে আইনজীবীদের বেশকিছু ভুল সিদ্ধান্ত্মই দায়ী। এ জন্য বিএনপি ও আইনজীবীরা সবাই হতাশ। আইনজীবীদের মধ্যে বিভক্তি ছাড়াও জোটের সঙ্গে মনোমালিন্য বিএনপিকে বেশ ভাবাচ্ছে। আন্দোলন জোটগতভাবে করা এবং নির্বাচনের বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত্ম চাচ্ছে ২০ দলীয় জোটের শরিক কয়েকটি দল। এ জন্য তারা প্রার্থী তালিকাও বিএনপিকে দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া মুক্তি আন্দোলনে জোটের ব্যানারে করার সিদ্ধান্ত্ম নেয়া হয়েছিল। সে হিসেবে জোটের নেতাদের সামনে রেখে কর্মসূচি পালনের জন্য চাপও দিয়েছে শরিক দলের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু বিএনপি নেতারা দলের কর্মসূচিতে জোট নেতারা হাজিরা দিলেও চলবে বলে জানিয়ে দেয়। ফলে ক্ষুব্ধ হন জোটের শরিক নেতারা। এর অংশ হিসেবে শরিক দলের শীর্ষ এক নেতা বিএনপি মহাসচিবকে জোটের ব্যানারে কর্মসূচি পালনের চাপ দিলে দুই নেতার মধ্যে বাকবিত-ার সৃষ্টি হয়। তখন ওই শরিক দলের নেতা বিএনপির অনেক নেতা সরকারের হয়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেন। এদিকে জোটের শরিক কয়েকটি দল এখনই আসন নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত্ম করতে বিএনপিকে চাপ দিচ্ছে। তবে গত নির্বাচনের মতো এবার একই ভুল তারা করবেন না বলে বিএনপিকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে।
বিএনপি সূত্র মতে, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তারেক রহমানের পরামর্শে যৌথ নেতৃত্বে বিএনপি চলছে। দলের মধ্যে ঐক্য আগের তুলনায় বেড়েছে বলে বিএনপি নেতারা দাবি করলেও দলে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। একই দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একেক নেতা দলীয় কৌশল নিয়ে একেক ধরনের কথা বলছেন। এ ছাড়া অকারণে দিনে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনও করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্দোলনের জন্য কর্মীদের চাপের পাশাপাশি সিনিয়র নেতাদেরও তেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত্ম নেয়ার জন্য বৈঠক ডাকা হলেও নানা অজুহাতে অনেকে তাতে যোগ দিচ্ছেন না। গত বুধবার বিকালে কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের আগে পরামর্শ করতে দলের সিনিয়র নেতাদের ডেকেছিলেন বিএনপি মহাসচিব। কিন্তু সময়মতো শুধু ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ছাড়া কেউই যাননি। এর আগে মঙ্গলবার আইনজীবীদের সঙ্গে বসতে চেয়েছিলেন মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু সব আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনের অজুহাতে বসতে অস্বীকৃতি জানান। এদিকে সম্প্রতি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নিয়ে দুই দফা বৈঠকের তারিখ দিয়েও তা বাতিল করা হয়।
জানা গেছে, মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বৈঠক করতে পারেননি। তারা মহাসচিবকে বলেছেন, 'তাদের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের যোগাযোগ আছে। তাই নতুন করে বসার দরকার নেই।'
বিএনপি সূত্র মতে, দলের সিনিয়র নেতা, বিশেষ করে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই মির্জা ফখরম্নলের। প্রকাশ্যে তার নেতৃত্ব মেনে নিলেও, দু-একজন ছাড়া কারও সহযোগিতা পাচ্ছেন না তিনি। এমন পরিস্থিতিতে মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর তার একান্ত্ম ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, 'সবাই মিলে যদি আমরা কাজ করতাম তাহলে অন্ত্মত সরকারকে একটা বার্তা দেয়া যেত। সরকারের একটু হলেও টনক নড়ানো যেত। কিন্তু এখন এসব কিছু করা যাচ্ছে না। সবাই দায়সারা।' এ ছাড়া দাপ্তরিক বিষয়ে পুরো নিয়ন্ত্রণ নেই বিএনপি মহাসচিবের। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনের আগে সিনিয়র দুই নেতার মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। আর সংবাদ সম্মেলন কখন হবে, কে করবে- এ ব্যাপারে কোনো সমন্বয় নেই। এ জন্য কোনো কারণ ছাড়াই একদিনে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন ডাকার ঘটনাও ঘটেছে।
সূত্র মতে, দলের সমন্বয়হীনতা দূর করে গতি ফিরিয়ে আনতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের আন্দোলন জোরদার করা, ২০ দলীয় জোটের শরিকদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো, ২০ দলীয় জোট এবং সরকারি জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎভাবে কর্মসূচি চূড়ান্ত্ম করা ও রাজধানী ঢাকাসহ জেলা ও মহানগরীতে জনসভা এবং কর্মিসভা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ জন্য সারাদেশে ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার জন্য ৩৭টি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন