সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় কয়েকজন তরুণ লেখক র্যাগ ডে আর র্যাগিংকে এক করে তাল-গোল পাকিয়ে ফেলেছেন। তাই লেখার প্রথমে র্যাগ ডে ও র্যাগিং শব্দের বোধগত অর্থ নিয়ে আলোচনা করব। র্যাগ ডে একটি ইংরেজি প্রবাদ। যার বাংলা অর্থ পড়ালেখা শেষের হৈ চৈ পূর্ণ দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের এই বিদায় অনুষ্ঠান বেশ ঘটা করে নাচ-গান ও হাসি তামাশার মাধ্যমে পালন করে।
আর র্যাগিংয়ের অর্থ হল পরিচিত হওয়া, তিরস্কার করা ইত্যাদি। আরও ভালভাবে বলতে গেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন আসা শিক্ষার্থীদের সাথে পুরাতন শিক্ষার্থীদের একটি সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা তাকে র্যাগিং নামে অবহিত করা হয়। কিন্তু এই পরিচিতি পর্ব কালক্রমে হয়ে পড়েছে মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের হাতিয়ার।
তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন ব্যাচ আসার সাথে সাথেই র্যাগিংয়ে নবীনদের অসুস্থতার খবর আসে। এই নিপীড়ন যেন একটি নিয়ম আর অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। র্যাগিং কি পরিমাণ শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন করার মাধ্যম হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ব্যাধি হয়ে দাড়িঁয়েছে তা আশঙ্কাজনক।
সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধলগ্ন করে ছয় শিক্ষার্থীকে র্যাগিং করা হয়। পরে অর্ধলগ্ন ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করতে বাধ্য করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রবেশ করেছে নবীন ৪৭ তম ব্যাচ। দেশের একমাত্র আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নবীন শিক্ষার্থীদর জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ প্রশাসন। তাই ৪৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের গণরুম নামক একটি রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। সেই গণরুমে আবার প্রতি রাতে কতিপয় সিনিয়ররা রাত জাগিয়ে র্যাগ দিচ্ছে। আবাসন সংকট আর র্যাগিংয়ের নিপীড়নে তাদের ক্যাম্পাস জীবন বিষাদময় যেন প্রতি মুহূর্তে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের এক ছাত্রকে মানসিক নির্যাতন করেছে ওই বিভাগের ৪৬ ব্যাচের কতিপয় শিক্ষার্থীর। ছেলেটা মানসিকভাবে এতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে সে তার পিতাকে চিনতে পারছে না।
ছেলেটি মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর নড়েচড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রশাসনের কাছে র্যাগিং বন্ধের দাবি জানায় শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষক মঞ্চ। এমনকি তারা বেশ কয়েকদিন হলগুলোতে নবীন ছাত্রদের খোঁজ নিতে ও যান।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র্যাগিংয়ের শাস্তি আজীবন বহিষ্কার বলে প্রজ্ঞাপন জারি করে বসে আছে । র্যাগিং বন্ধ করতে প্রশাসনের কোন নজরদারি নাই। হলে হলে প্রতিরাতে শেষ রাত অবধি যে র্যাগিং দেয়া হচ্ছে তা বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেই হল প্রশাসনের। যেহেতু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় র্যাগিং চলে তাই প্রশাসন তাদের বিরাগভাজন হতে চাই না। খুবই হাস্যকরভাবে পরিস্থিতির চাপে আওয়ামীপন্হী শিক্ষকেদের ব্যানারে র্যাগিং বন্ধে মানববন্ধন করে বেশ কয়েকটি বিভাগের সভাপতি,হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষক। অথচ তাদের দায়িত্ব প্রাপ্ত হলগুলোতে তাদের নাকের ডগায় প্রতি রাতে চলছে র্যাগিং। তাই প্রশ্নে উঠেছে বিড়ালের গলায় আসলে ঘন্টাটা আসলে বাধঁবে কে?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য র্যাগিংয়ের বন্ধে প্রত্রিকায় বিশাল এক উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন। অথচ তার সময়ে র্যাগিং আরো ভয়াবহ রূপ ছিল। ব্যাপারটা এমন যেন যে যায় লংকায় সে হয় রাবণ।
ফলস্বরূপ প্রতিনিয়ত র্যাগিংয়ে শিক্ষার্থী নিপীড়নের খবর আসছে প্রতিনিয়ত।
গত ২ মার্চ ঘটে ভয়ঙ্কর ঘটনা। শহীদ রফিক –জব্বার হলের ৪৭ তম ব্যাচের গণরুমে ৪৬ তম ব্যাচের ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন কর্মী ঢুকে কান ধরা, এক পায়ে দাড়িঁয়ে থাকা এবং পরে জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে থাকতে বলে। ঝুলে থাকা থেকে পরে গিয়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে আহত হয় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের আজওয়াদ আহমেদ। আজওয়াদের আঘাত এতই গুরুতর ছিল যে বিশ্বদ্যিালয়ের মেডিকেল থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
র্যাগিং মেয়েদের হলগুলোর চেয়ে ছেলেদের হলগুলোতে বেশী গুরুতর। আপেক্ষিকভাবে ছেলেদের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ। সারারাত রাত জাগিয়ে র্যাগিং চলার পর তাদের পক্ষে ক্লাসে নিয়মিত হওয়া কঠিন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিছি ২০১৫ সালে। সেই থেকে আমার পর্যবক্ষণে প্রতিবছর ই র্যাগিং নিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে জাাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশীরভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী র্যাগিংপ্রথার বিপক্ষে। গুটিকয়েক কতিপয় যে কয়েকজন ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় ও প্রশাসনের আস্কারায় নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগ দিচ্ছে তারা নিপীড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন দায়ে অপরাধী। যেহেতু ক্যাম্পসের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ র্যাগিংয়ের বিপক্ষে তাই প্রশাসন চাইলে র্যাগিং বন্ধ করা যায়। ছাত্রলীগের মূলনীতি তে আছে.‘শিক্ষা.শান্তি,প্রগতি’। বাংলাাদশের বহু গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের অংশীদার ছাত্রলীগ। তাই ছাত্রলীগের উচিত শিক্ষার সুষ্ঠ পরিবেশের স্বার্থে র্যাগিং অপসংস্কৃতির পুনর্বাসন বন্ধ করা।
শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন