যার নামের মধ্যে সার্থকতা ছিল লুকিয়ে। বাবা-মা মেয়ের নাম আদর করে রেখেছিলেন ‘পৃথুলা’। তারা কি বুঝতে পেরেছিলেন তাদের এই মেয়েটাই বড় হয়ে আকাশ দাপিয়ে বেড়াবে! হয়তো বা নইলে তারা সন্তানের এমন নাম রাখবেন কেন? পৃথিবীজুড়ে (পৃথুলা) থাকবে যার সরব পদচারণা। আর মেয়েটারও মুক্ত নীল আকাশে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে সেই শৈশব থেকেই।
তাই চলতি পথে ‘ভু- ভু’ আওয়াজ তোলা উড়োজাহাজ দেখলেই অপার বিস্ময়ে আকাশে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকত অপলক দৃষ্টিতে। শৈশব থেকেই মনের মধ্যে বীজ বুনেছিল পাখির মতো ডানা মেলে সেও অবারিত আকাশে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াবে। কোনো বাধার কাছে সে হার মানবে না।
পৃথুলা যার অর্থ বিশ্ব। নামটি সার্থক হয়ে তার প্রতি করেছিল সুবিচারও। তাই বলে এত অল্পতেই হারিয়ে যাওয়া? মানা যায় না মেটেও। স্বপ্নের দীর্ঘ যাত্রা থেমে গেল অতি অল্প মুহূর্তের মধ্যে। কলিতেই ঝরে গেল ফুল, হলো না বিজয়ের গাঁথা মালা...।
মনের মাঝে দীর্ঘদিনের লালন করা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে বৈমানিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পৃথুলা। অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলে। নিজেকে সেভাবে গড়েও তোলে। এমন ধনুভাঙা পণ যার, তাকে রুখবে কার সাধ্য? মনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলেও ক্যারিয়ার জীবনের মাত্র দেড় বছরের মাথায় এসে আচমকাই আকাশের নক্ষত্রের মাঝে হারিয়ে গেল তরতাজা প্রাণটি। কোথায় নিজের ক্যারিয়ারকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে, না হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।
একমাত্র সন্তান হওয়ায় মেয়ের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেননি বাবা-মা। মা তার হৃদয়ের সবটুকু মমতা দিয়ে আগলে রেখেছেন মেয়েকে। অথচ স্নেহময়ী মায়ের হৃদয়ে আজ চরম রক্তক্ষরণ। কালো মেঘের মাঝে ঢেকে গিয়েছে পৃথিবী (পৃথুলা)। হারিয়ে গেছে বুকের মানিক, দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় ঝরছে অশ্রুধারা। এ অশ্রুধারা রোধ করার ক্ষমতা কারো নেই।
অভিশপ্তের খাতায় নাম উঠল ১২ মার্চের সকালের দিনটা। এদিন নেপালে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় চিরদিনের জন্য প্রাণপ্রদীপ নিভে যায় পৃথুলার সঙ্গে অন্যদেরও। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে মা এখন পাগলপ্রায়। মায়ের কাছে পৃথুলার রেখে যাওয়া অফুরন্ত স্মৃতি। মেয়ের গায়ের পোশাক, খেলার পুতুল, বই-খাতা সবই জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন মা। কিছুতেই থামছে না আহাজারি।
গত ২০ মার্চ মিরপুর ডিওএইচএসে পৃথুলার বাসায় গিয়ে দেখা য়ায়, ইউএস-বাংলার বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে বাবা আনিসুর রশিদ ও মা রাফেজা বেগমের দিনগুলো হিমকরা রাতের অন্ধকারে যেন থমকে গেছে। গোসল নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই। সব সময় কেমন যেন বেসুরোভাবে এলোমেলো দিনগুলো কাটছে একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে ভাগ্যাহত এই দম্পতির। ডায়াবেটিস আর থাইরয়েড ক্যান্সার আক্রান্ত রাফেজা বেগম। মেয়ের পরনের কাপড় বুকে নিয়ে শূন্য সারা ঘরে বিলাপ করে বেড়াচ্ছেন। তাকে থামানেই দায় পরিবারের অন্য সদস্যদের।
একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর এই জননী। কি বলেই বা তারা রাফেজা বেগম সান্ত্বনা দেবেন? সে ভাষা কারো জানা নেই। তদুপরি পৃথুলার মৃত্যুতে পুরো পরিবারে চলছে শোকের মাতন। পৃথুলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে বাড়ির প্রতিটি আসবাবপত্র ও ইটের কনায়।
মেয়ের জন্য রাফেজা বেগমের দু'চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রুধারা। বিলাপ করতে করতে বলছেন, মা তোমাকে স্যালুট। অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছো, আমি গর্বিত। আল্লাহ তোমায় জান্নাতবাসী করুক। কথা বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন পৃথুলার মা। এ সময় পৃথুলার বাবা আনিসুর রশীদ ও মামাসহ স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে পৃথুলার মা বলেন, কোনোদিন আমাকে না খাইয়ে ঘুমাতে যেত না আমার মেয়ে। মুখে তুলে খাইয়ে দিত, ঘুম পাড়িয়ে দিত। আমার ওষুধ খাওয়ার সময় হলে ফোন দিত। বাচ্চাদের মতো আমার যত্ন নিত। অফিস থেকে ফিরেই মা-মা বলে চিৎকার করত। এখন আমার আর কেউ রইল না। মা বলে আমাকে আর কেউ কোনোদিন ডাকবে না। চিরদিনের জন্য আমার বাবুটা হারিয়ে গেল।
তিনি বলেন, খুব কষ্ট করে একমাত্র মেয়েকে বড় করেছেন। পাইলট হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। সফলও হয়েছেন। কিন্তু দুর্ঘটনায় চিরদিনের জন্য হারিয়েছেন মেয়েকে। রাফেজা বেগম বলেন, পৃথুলার ইচ্ছে ছিল মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর। মেয়ে পাইলট হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পৃথুলার সেই রঙিন স্বপ্ন পূরণ হলো না। মেয়েটা আমার হারিয়েই গেল নক্ষত্রের মাঝে। আর ফিরে পাব না।
খুব কষ্ট করে একমাত্র মেয়েকে বড় করেছেন। পাইলট হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন মা। সফলও হয়েছেন। কিন্তু দুর্ঘটনায় চিরদিনের জন্য হারিয়েছেন মেয়েকে। রাফেজা বেগম বলেন, পৃথুলার ইচ্ছে ছিল মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর। মেয়ে পাইলট হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পৃথুলা সেই রঙিন স্বপ্ন পূরণ হলো না। মেয়েটা আমার চুপি চুপি হারিয়ে গেল।
পৃথুলার ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বাম দেয়ালে আটকানো বিশাল আকৃতির পোস্টার। পোস্টারটির একেবারে ওপরে বাঁয়ে লেখা ফ্লাইট সেফটিবোম্বার্বাডিয়ার কিউফোরজিরোজিরো। তার পাশে উড়োজাহাজটির ককপিট প্যানেলের ছবি।
তিনি বলেন, দু'চোখ বুঝলেই শুধু পৃথুলার মুখটা চোখে ভাসে। ওর মা ডাক সব সময় আমার কানে বাজে। এক মুহূর্তের জন্য মেয়ের মায়াভরা মুখটা আচ্ছন্ন হয় না। কাউকে দেখানো যায় না। বড় কষ্টের, বড় বেদনার। আমার সব শেষ, আমি তো নিঃস্ব হয়ে গেলাম এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব।
রাতে আমার ঘুম না আসা পর্যন্ত সে নিজের ঘরে যেত না, আমাকে প্রতি রাতে সে গুড নাইট বলে নিজের ঘরে যেত। এখন আমাকে কে ঘুম পাড়াবে? পৃথুলা ছাড়া ঘর যে আমার শূন্য। সেই ঘরে আর কোনোদিন মেয়েটা ফিরবে না।
সন্তানহারা এই জননী বলেন, পৃথুলা আমার পৃথিবী। আমার বুকের মানিক। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব কী করে। সুস্থ, সুন্দর মেয়ের মুখটা আর দেখতে পেলাম না। মেয়ে আমার কফিনে বন্দি হয়ে ফিরল।
স্বজনরা জানান, ছোটবেলা থেকেই পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল পৃথুলা রশীদের। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় তার ইচ্ছাকেই বড় করে দেখেছেন পরিবারের সবাই। পৃথুলার বাবা আনিসুর রশীদ ২১ বছর রাশিয়ায় ছিলেন। অনেক কষ্টে মা একাই মেয়েকে বড় করে তুলেছেন।
ইংরেজিমাধ্যম স্কুল একাডেমি থেকে এ লেভেল ও এই প্রাইভেট ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল থেকে ০ লেভেল সম্পন্ন করেন। পরে বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন অথরিটির ভেতরে স্থাপিত অরিয়াম ফ্লাইট একাডেমি থেকে পাইলটের কোর্স সম্পন্ন করেন। এছাড়া পৃথুলা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন।
নিহতের স্বজনদের পাশে সরকার, ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ আর বেদনাহত মানুষ। তবু তাদের প্রিয়জন হারানোর ক্ষত শুকাবে না কোনোদিন। প্রাণহীন মানুষও আর ফিরবে না। এত তাজা প্রাণ হিমালয় দেখতে নেপাল গিয়ে ফিরল কফিনে বন্দি হয়ে।
এমন দুর্ঘটনা নিয়ে বরাবরই কথার বাজার বসে। চলে তর্ক-বিতর্ক। এর ফাঁকে মৃত্যু-অপমৃত্যু থমকে দাঁড়ায় না, বরং ওই মিছিল আরও দীর্ঘ হয়। গত ১২ মার্চ দুপুরে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের আগমুহূর্তে বিধ্বস্ত হয় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট। বিমানটিতে ৩৬ বাংলাদেশিসহ ৭১ আরোহী ছিলেন। এর মধ্যে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৫১ জন নিহত হন।
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী বৈমানিক হিসেবে বাণিজ্যিক বিমান পরিচালনার সনদ পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন সৈয়দ কানিজ ফাতেমা রোকসানা। ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে একটি ফকার এফ-২৭ নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। বিমানটির ৪৫ যাত্রী ও ৪ ক্রু নিহত হন ওই দুর্ঘটনায়।
এরপর ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার পোস্তগোলায় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান আরেক নারী প্রশিক্ষক পাইলট ফারিয়া লারা। ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহী বিমানবন্দরে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন প্রশিক্ষণার্থী পাইলট তামান্না রহমান। আত্মরক্ষাসহ অন্যদের বাঁচাতে কম চেষ্টা করেননি রোকসানা-পৃথুলারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন