গত কয়েক দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রতিটি রাতই ভয়ঙ্কর ত্রাসের পরিবেশ নিয়ে এসেছে। কখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবার কখনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর নানামুখী চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ইসু্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসগুলোতে ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে। দিন যতই যাচ্ছে সেখানে সন্দেহ-অবিশ্বাস ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অদক্ষতা, বারবার অবস্থান পরিবর্তন এবং অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত্মে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলার আকার ধারণ করছে।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার দাবিতে রোববার ঢাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের একটি অংশ মানববন্ধন করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনগুলোর মুখোমুখি অবস্থানে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী তৎপরতাকে অনেকেই বিপদের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিস্থিতি নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সকালে এক কথা বলছেন বিকালে আরেক কথা বলছেন। নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা হচ্ছে। বাস্ত্মবিক অর্থে এ মুহূর্তে আমরা অভিভাবকহীন। গত আট তারিখে যখন পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালায় তখন তাদের সঙ্গে বহিরাগতরাও ছিল। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে 'আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্ত্মান' সংগঠনের সভাপতি মেহেদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করছেন। ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া হয়েছে। অথচ এদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অজ্ঞাতনামা আসামির নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। রাত হলেই ভয়ে থাকি আজ কোন হলে কাকে মারা হবে, কাকে বের করে দেয়া হবে।'
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সৌমিত্র শেখর যায়যায়দিনকে বলেন, 'ছাত্র-শিক্ষক বা প্রশাসনের মধ্যে যদি কোন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েও থাকে তবে সবার উচিত এক সঙ্গে বসে তার সমাধান করা। ছাত্ররাও আমাদের, শিক্ষকরাও আমাদের। এখানে কারও সঙ্গে শত্রম্নতা করার সুযোগ কারো নেই।'
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গত কয়েক দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রতিটি রাতই ভয়ঙ্কর ত্রাসের পরিবেশ নিয়ে এসেছে। কখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবার কখনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর নানামুখী চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের। এসব প্রতিকূল অবস্থায় অনেকেই হল ছেড়েছেন। তবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরা বলছেন, যত প্রতিকূল পরিস্থিতিই সৃষ্টি হোক না কেন পিছিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন এখনো জারি হয়নি। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘটিত বিভিন্ন সহিংসতা, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়ানো নানা গুজবসহ বিভিন্ন কারণে দায়ের হওয়া চারটি মামলায়ই করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরম্নদ্ধে। এসব অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এখন অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে গোয়েন্দা তৎপরতা। বিশেষ করে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের যেভাবে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হচ্ছে তা শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত করে তুলছে। আর এ কাজটি করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে থাকা একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমেই। রয়েছে বহিরাগতরাও।
আবার প্রায় প্রতিটি রাতেই কোন না কোন ছাত্রবাসে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন নতুবা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন কর্তৃক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা-ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে। কথায় কথায় হল থেকে বের করে দেয়া বা হল ছাড়া করার হুমকিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও একটি ছাত্র সংগঠনের বিরম্নদ্ধে ক্ষোভ, আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর সন্দেহ বাড়াচ্ছে।
কোটা সংস্কারের পক্ষের শিক্ষার্থীদের ফেসবুক আইডিতেও চলছে চুলচেরা তদন্ত্ম। পাঁচ ছয় বছর আগে কে কি পোস্ট দিয়েছে তা ছড়িয়ে দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য বানানোরও কাজটি অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে। বাদ যাচ্ছে না ছাত্রলীগের পদধারী আন্দোলনকারীরাও।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাদের নামে একাধিক ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করে পোস্ট দিয়ে তা তাদের নামে চালানো হচ্ছে। এরই মধ্যে 'গুজবে কান দেবেন না' নামক একটি ফেসবুক গ্রম্নপ খুলে সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের বিরম্নদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণাও চালাতে দেখা গেছে। স্বাধীনতাবিরোধী অনেক পোস্ট ও তার স্কিন শট এখানে শেয়ার করা হয়েছে। এসব শেয়ারের ক্যাপশনে লেখা কোটা সংস্কার আন্দোলনের অমুক নেতা স্বাধীনতাবিরোধী এই পোস্টটি দিয়েছে। আবার কার কার পরিবারে কয়জন রাজাকার আছে বা ছিল সেসব পোস্টেও ভরপুর এ গ্রম্নপটি।
যাদের নাম ধরে এসব পোস্ট দেয়া হয়েছে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে তারা এসব ফেসবুক আইডি এবং পোস্ট সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছেন। আবার এ গ্রম্নপটি যারা চালাচ্ছে তাদের ইনবক্সে ওইসব পোস্টের সূত্র জানতে চেয়ে একাধিকবার মেসেজ পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। গত কয়েক দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের আরও কয়েকটি গ্রম্নপ খোলা হয়েছে এবং একই ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব অপপ্রচার চালিয়ে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে কার্যত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করে যৌক্তিক আন্দোলনকে স্ত্মিমিত করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। আর এসব কারণেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ আর অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে মধ্যরাতে কয়েকজন ছাত্রীকে বের করে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ওই ঘটনায় জাতীয় পর্যায়েও তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, 'ওই রাতের ঘটনায় আমি স্ত্মম্ভিত হয়েছি। এ ধরনের শাস্ত্মি কিভাবে ঠিক হলো?'
শুধু সুফিয়া কামাল হলেই নয় স্যার এ এফ রহমান হল, বঙ্গবন্ধু হল, ফজলুল হক হলসহ অন্যান্য হলেও শিক্ষার্থীদের হয়রানি বা হলে ঢুকতে না দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারম্নজ্জামানের বক্তব্য, কাউকে বের করে দেয়া হয়নি। বরং তাদের অভিভাবকের কাছে তুলে দেয়া হয়েছে। এতে তাদের অভিভাবকরা খুশি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বলেও দাবি এ উপাচার্যের।
এদিকে যে চারটি অজ্ঞতনামা মামলা নিয়ে এত শোরগোল তা তুলে নিতে এরই মধ্যে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তাদের ভাষ্য এ মামলার নামে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে ও তুলে নেয়া হচ্ছে এবং হলে ক্যাম্পাসে তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এ কারণেই তারা অজ্ঞতানামা মামলা তুলে নেয়ার দাবি জানিয়ে ভিসির বাড়িতে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরম্নদ্ধে মামলা দেয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একমত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন একে ছাত্রদের অধিকার বলে দাবি করেছেন। তার মতে, 'শিক্ষার্থীরা যাতে কোনোরকমের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার না হয় তা সরকারও চাচ্ছে। কারণ, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্ত্মিত শিক্ষার্থীরাই এই আন্দোলন করছে। পুলিশের তৎপরতা দেখে মনে হয়েছে, সরকার একদিকে এবং পুলিশ অন্যদিকে। শান্ত্মিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের হঠাৎ চড়াও হওয়া নিয়ে শুরম্নতেই আমার প্রশ্ন ছিল। উপাচার্যের বাসায় দুই ঘণ্টা যাবৎ তা-ব চালানোর সময় পুলিশ কী করেছে? উপাচার্যের বাসায় তো পুলিশ সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রান্ত্মে শাহবাগ থানা ও নীলক্ষেত থানা থাকলেও ঘটনার সময় তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এই আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা পুরোটাই প্রশ্নবিদ্ধ। আর শিক্ষার্থীরা হয়রানি থেকে বাঁচতে মামলার প্রত্যাহার চাইছে। এটা শুধু ন্যায্যই নয় তাদের অধিকারও বটে।'
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় রাজশাহী, চট্টগ্রাম, শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ করেছেন। ওইসব ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের আন্দোলনে না যেতে বলা হয়েছে। এবং গেলে হল থেকে বের করে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী যায়যায়দিনকে বলেন, 'হলের শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখানো এখন সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তবে শঙ্কার বিষয় হলো প্রশাসনও এখন এতে যোগ দিয়েছে।'
অবশ্য এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ছাত্রলীগের কয়েক জন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তাদের কোন মন্ত্মব্য পাওয়া যায়নি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকে নানা বক্তব্য আসছে। কিন্তু লন্ডন থেকে আসা একটি ফোন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। শনিবার নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সরকারের চামচামি না করে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরম্নর আহ্বান জানিয়েছেন। রাজনীতিবিদদের এসব বক্তব্য ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ধারাবাহিকভাবে হয়রানির সুযোগে নিয়ে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে টানার চেষ্টা হচ্ছে বলেও মনে করছেন অনেকে।
তবে আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন যায়যায়দিনকে জানান, তারা রাজনীতিবিদদের স্বার্থ হাসিলে সিড়ি হিসেবে কখনোই ব্যবহৃত হবেন না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন