দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। আজ মঙ্গলবার বঙ্গভবনের দরবার হলে তাকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হবে।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি, দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিচারক, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, আইনপ্রণেতা, সিনিয়র রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন। এরই মধ্যে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলেও জানান তিনি।
১৯৯০ সালের পর গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে এই প্রথম টানা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন আবদুল হামিদ। এর মধ্য দিয়ে দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে এ রেকর্ড গড়বেন এ অনন্য নেতা।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেছিলেন। সে সময় ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন তিনি। তবে ওই বছরের ২০ মার্চ ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে সংবিধান অনুযায়ী, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন আবদুুল হামিদ। গত ২৭ মার্চ তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর গত ৯ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন এবং রাষ্ট্রপতি আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন আবদুুল হামিদ।
এ বছরের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন ধরে ঘোষিত তফসিলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। আর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সময় নির্ধারিত হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন ছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। ১৯৯০ সালের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় ফেরার পর থেকে সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসছেন রাষ্ট্রপতি। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ নেই কারও। এবারও দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় আবদুল হামিদকে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবদুল হামিদ ছাড়া আর কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা পড়েনি। আবদুল হামিদের পক্ষেই মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল তিনটি। প্রথম মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক ছিলেন সংসদ সদস্য ওবায়দুল কাদের এবং সমর্থক সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। দ্বিতীয় মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক ছিলেন সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, সমর্থক ছিলেন সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ। তৃতীয় মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সমর্থক সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক। সিইসি সে সময় জানিয়েছিলেন, প্রথম মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পরই টিকে গিয়েছিল আব্দুল হামিদের প্রার্থিতা। এর ফলে পরের মনোনয়নপত্রগুলো যাচাইয়ের প্রয়োজন হয়নি। ইসির পক্ষ থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয় আবদুল হামিদকে। নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আবদুল হামিদ একমাত্র বৈধ প্রার্থী হওয়ায় রাষ্ট্রপতি আইন ১৯৯১-এর ৭ ধারা অনুযায়ী, আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে।
গণতন্ত্র ফেরার পর দেশে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারে আসার পর একবার ভোট হয়েছিল রাষ্ট্রপতি পদে। সে ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুর রহমান বিশ্বাস। এরপর থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আমলে রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। ২০০১ সালে বিএনপির পরের আমলে প্রথমে অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং পরে অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দীন আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিল্লুর রহমান। ২০১৩ সালে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে আবদুল হামিদ কিছুদিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের সংবিধান এক ব্যক্তির দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিধান রয়েছে। আবদুল হামিদই দেশের প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রে টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
আবদুল হামিদের বর্ণাঢ্য জীবন
১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল হামিদ। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে চলতি বছর তিনি স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। একজন সাধারণ ও অনন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবদুল হামিদ সর্বজনগ্রাহ্য। দীর্ঘ সংগ্রামী ও লড়াকু রাজনৈতিক জীবনে বিলাস-বৈভব ও প্রদর্শনবাদ এড়িয়ে চলেছেন সবসময়। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের ধরাবাঁধা জীবনের বাইরে সবসময় সাধারণ জীবনযাপনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে তার কথায়। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে জীবনের সব আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিতে কখনো কার্পণ্য করেননি তিনি।
রাজনৈতিক জীবনে টানা সাতবার নিজের এলাকায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে তার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৮ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন। সপ্তম সংসদে ১৯৯৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০০১ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালনের পর ২০০১ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত স্পিকার হিসেবে সংসদ পরিচালনা করেন আবদুল হামিদ। আর নবম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো স্পিকার হন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন