ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেছেন, ঘটনার পাঁচ বছর পার হলেও এখনো রানা প্লাজার ঘটনার বিচার হচ্ছে না। অপরাধীরা উচ্চ আদালত থেকে এর স্থগিতাদেশ পান। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে যারা প্রভাবশালী তাদের হস্তক্ষেপেই এ বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। তা না হলে দিনদুপুরে এক হাজার ১০০ মানুষকে হত্যা করা হলেও তার নাকি সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না।
গতকাল রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘তৈরী পোশাক খাতে সুশাসন : অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এখনো আমাদের বিচার বিভাগ স্বধীনভাবে কাজ করছে না। তা না হলে স্পেকট্রাম ফ্যাশন্স, তাজরীন ফ্যাশন্স ও রানা প্লাজার মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে বারবার পোশাক শ্রমিকেরা প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও এখনো কোনোটাই বিচারের মুখ দেখছে না। বিচারের জন্য যেসব প্রক্রিয়া দরকার হয় তা সবগুলোকেই কোনো-না-কোনোভাবে প্রভাবিত করে বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করা হচ্ছে।
গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির সহকারী প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা। নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ঘটনার পর এটি সংগঠনটির চতুর্থ ফলোআপ প্রতিবেদন। ওই বছরের ১৩ অক্টোবর টিআইবি প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে এ খাতে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দায়িত্বে অবহেলা, রাজনৈতিক প্রভাব ও পারস্পরিক যোগসাজশে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিকে চিহ্নিত করা হয় এবং এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৫ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। গতকালের প্রকাশিত প্রতিবেদন এসব সুপারিশের অগ্রগতি ও এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলোই উঠে আসে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তৈরী পোশাক খাত দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮১ দশমিক ২৩ শতাংশ জোগান দিচ্ছে, যা দেশের মোট জিডিপির ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ অবদান রাখছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতা ও স্বদিচ্ছার অভাবে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরছে না। শ্রমিকেরা পাচ্ছেন না তাদের প্রাপ্য মজুরি। উদ্যোক্তারা ব্যবসায় সম্প্রসারণ ও আয় বৃদ্ধি নিয়ে যত সচেতন, যাদের শ্রমে তাদের এ উপার্জন সেই শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রদানে তারা ততটাই পিছিয়ে। ২০১৩ সালে মজুরি বোর্ড কর্তৃক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়, যা বর্তমান বাজারের সাথে কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের একই অর্থনৈতিক অবস্থায় থাকা কম্বোডিয়ায় পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ১৯৭ ডলার উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সে ক্ষেত্রে বর্তমানের ৬৮ ডলার থেকে বৃদ্ধি করে দ্রুতই তা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার। কারণ এ মুহূর্তে আমাদের পোশাক শ্রমিকদের বেতন এ রফতানিকারক অন্যান্য প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সর্বনি¤œ। পাকিস্তানে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৯৪ ডলার, ভারতে ১৬০ ডলার, ভিয়েতনামে ১৩৬ ডলার একং ফিলিপাইনে তা ১৭০ ডলার। সে হিসাবে এ মুহূর্তে দেশে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত ২০২ ডলার। অথচ আমাদের দেশের ন্যূনতম বেতন ৬৮ ডলার ধরা হলেও তাও ঠিকমতো পরিষোধ না করার অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন কারখানার বিরুদ্ধে।
২০১৭ সালের মে মাস থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত কমপক্ষে ৮০টি কারখানার ১২০ জন শ্রমিক, সরকারি বিভিন্ন বিভাগ ও পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের কাছ থেকে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
আরও বলা হয়, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে এ পর্যন্ত ৬৩২টি ট্রেড ইউনিয়নের অস্তিত্বের কথা শোনা গেলেও কারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের জরিপ অনুযায়ী মাত্র ৩ শতাংশ কারখানাতে ট্রেড ইউনিয়নের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। আর এ গুলোর বেশির ভাগই মালিক নিয়ন্ত্রিত যেখানে নেতৃত্বের কোন্দল ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিসহ ইউনিয়নের সাথে জড়িতদের চাকরিচ্যুতির অভিযোগ রয়েছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, রানা প্লাজা ঘটনার পর থেকে ক্রমান্বয়ে তৈরী পোশাক খাতে নারিশ্রমিকদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৩ সালে এ খাতে নারী শ্রমিকের হার ছিল ৮০ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশে। নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাসহ বারবার এ খাতে সংঘটিত অপরাধের বিচার না পাওয়ায় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তৈরী প্রতিবেদনের আলোকে টিআইবি কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরে যার মধ্যে ছিলÑ
এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য একক কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এ পর্যন্ত সংঘটিত সব দুর্ঘটনার দায়েরকৃত মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে এবং শ্রমিকদের মজুরি, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, ছুটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে শ্রমিকের আইনগত অধিকার সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি তদারকি বাড়াতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন