দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বেশ টালমাটাল সময় পার করছে। বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো একদিকে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে, অন্যদিকে সরকারি অর্থ তাদের ব্যাংকে ৫০ শতাংশ জমা রাখার দাবিও আদায় করেছে সরকারের কাছ থেকে। বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকে ৬০০ কোটি টাকার অনিয়মের পর থেকেই ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার শুরু হয়। শুধু ফারমার্স ব্যাংকই নয়, গোটা ব্যাংকিংখাতই এখন দুর্যোগের মুখে। ছয়-সাত মাস আগেও বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক, যেখানে আমানতের উপর পাঁচ থেকে ছয় শতাংশের বেশি সুদ দিতো না, এখন তারাই দ্বিগুণ হারে সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে সুফল না পেয়ে সরকারি অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে আমানত রাখার সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। সেই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঘোষিত মুদ্রানীতির উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছে। নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের উল্টোনীতির কারণে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই হরিলুট ও ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচারের পথ আরো সহজ হয়েছে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।
মুদ্রানীতির উল্টোপথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
কিছু বেসরকারি ব্যাংকের আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে লাগাম দিতে জানুয়ারির শেষে যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল, তারল্য বাড়ানোর নামে ভোটের বছরে এখন তার উল্টো পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘ব্যাংক মালিকদের চাপে’ নগদ-জমার বাধ্যবাধকতা (সিআরআর) শিথিল করার পাশাপাশি রেপোর সুদহার কমানোর যে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে, তা তাদের মুদ্রানীতির সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। এসব পদক্ষেপ ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা দূর করার বদলে উল্টো অরাজকতা বৃদ্ধি করবে বলে সরকারকে সতর্ক করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তী অবশ্য চাপের কথা অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হিসেবেই এসব পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছে।
সরকার এমন এক সময়ে এই পদক্ষেপ নিয়েছে, যখন শত শত কোটি টাকা অনিয়মের কারণে মাত্র চার বছর আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠিত ফারমার্স ব্যাংককে ধুঁকতে হচ্ছে। ব্যাপকহারে লুটপাটের কারণে অন্যান্য ব্যাংকের অবস্থাও করুন। ব্যাংকের তারল্য সংকটের মূল কারণ ভোটের আগে অর্থ পাচার কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে।
যে সুযোগ নিলো ব্যাংক মালিকরা
গত ১ এপ্রিল রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা-মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও গভর্নর ফজলে কবির সিআরআর এবং রেপো হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওইভাবে তা করতে পারে কি না, এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। ওই বৈঠকের পর বিএবির সদস্যরা ৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় সপরিবারে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আসেন। গণভবনে ওইদিন ব্যাংক মালিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ব্যাংকগুলোর আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমার বাধ্যবাধকতা ১ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা ১৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। এতদিন সব ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের আমানত হিসেবে পাওয়া অর্থের সাড়ে ৬ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা (সিআরআর) রাখতো। নির্দিষ্ট সময় পরপর জমার পরিমাণ হিসাব করা হত; নগদ জমার পরিমাণ কম হলে দিতে হত জরিমানা। এখন ওই হার কমিয়ে আনা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশে।
ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। ব্যাংকগুলো যাতে কম খরচে ধার পায়, সেজন্য রেপোর হার কমিয়ে আনা হয়েছে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট। এতদিন রেপোর ক্ষেত্রে সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তা কমিয়ে ৬ শতাংশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে এখন ব্যাংকগুলোর খরচ কমবে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। সেই সুদহার আগের মতই ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থাকছে। রেপোকে বলা হয় ব্যাংকিং খাতের নীতি উপাদান (পলিসি টুলস)। এর সুদ হারকে বলা হয় নীতি সুদ হার (পলিসি রেট)। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করলে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সাত দিন রাখতে পারে। এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রেপো হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআরকে ব্যবহার করে ব্যাংকের আমানতকারীদের রক্ষাকবচ হিসেবে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পলিসি টুলস ব্যবহার করে। এ উদ্দেশ্যেই ২০১৪ সালে বর্তমান সরকার টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সিআরআর ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছিল।
এখন সিআরআর ও রেপো হার কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থ পাওয়া আরো সহজ করে দিলো। কেবল সিআরআর কমানোর ফলেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে নতুন করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা যাবে বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা করছেন। এর বাইরে সরকারি তহবিলের অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার সুযোগও বাড়ানো হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলো এতদিন তাদের তহবিলের ৭৫ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এবং বাকি ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখত। সরকার ঠিক করেছে, এখন থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ৫০ শতাংশ রাখা হলে বাকি ৫০ শতাংশ রাখা হবে বেসরকারি ব্যাংকে।
ফারমার্স ব্যাংক নিয়ে জটিলতার অবসান হওয়ার আগেই সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বিস্মিত করেছে বিশ্লেষকদের। সরকারের জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের প্রায় ৫০৮ কোটি টাকা আমানত হিসেবে রাখা হয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন ফারমার্স ব্যাংকে। অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে তা আদায় করতে না পারায় ওই ব্যাংক এখন গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ফলে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু তহবিলের আমানতের টাকাও আটকে গেছে। ফারমার্স ব্যাংকের মত কিছু বেসরকারি ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিং করে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি হারে ঋণ প্রদানের কেলেংকারি ঘটায়। আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত জানুয়ারিতে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এ ধরনের ঋণে লাগাম টানার চেষ্টা করে।
সাধারণ ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) ৮৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৯ শতাংশ করা হয়। এর অর্থ হল, সাধারণ ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে ৮৩ টাকা ৫০ পয়সার বেশি ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। আর ইসলামী ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে ৮৯ টাকা ঋণ দিতে পারবে। যেসব ব্যাংক এই সীমার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে, তাদের ৩০ জুনের মধ্যে তা সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল সে সময়। কিন্তু ঋণ-আমানত অনুপাত সমন্বয় আনতে অনেক ব্যাংক তখন চড়া সুদে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। ফলে তৈরি হয় নতুন অস্থিরতা। যার প্রভাবে পুঁজিবাজারে টানা ধস চলতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে ব্যাংকগুলোকে পুরো ২০১৮ সাল সময় দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “ঋণ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই পদক্ষেপ অর্থহীন হয়ে পড়ছে, সিআরআর ও রেপো হার কমানোর কারণে। একটা হোটেলে বসে মুদ্রানীতির গুরুত্বপূর্ণ দুটি হাতিয়ার সিআরআর ও রেপো সুদহার কমানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এটা মুদ্রানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সিআরআর ও রেপো সুদহার কমানোর কারণে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়বে; সেই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। টাকার সরবরাহ বাড়ায় ব্যাংকগুলো বাছ-বিচার না করে যাকে তাকে ঋণ দেবে। বেড়ে যাবে খেলাপি ঋণ। সংকট আরও বাড়বে।” সাবেক এই গভর্নর বলেন, ব্যাংক মালিকদের চাপেই যে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটা ‘পরিষ্কার বোঝা যায়’।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে ৪ এপ্রিল ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান- সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেম। এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের পিলিসি মেকিংয়ের ইউনিট আছে, তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এখানে আমরা তা দেখিনি। আশ্চর্যের বিষয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোর দাবির মুখে।” এতে পুরো আর্থিক খাতে ‘ভুল সংকেত’ যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে ব্যাংকগুলো এখন খারাপ পারফর্ম করছে তাদের কাছে যদি আবার টাকা দেওয়া হয়, সেই টাকারও অপব্যবহার হবে না- সে নিশ্চয়তা তো নেই।” কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘দুর্বল নিয়ন্ত্রণ’-এর কারণে ঋণ খেলাপিদের শাস্তি না হওয়ায় অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ আগামীতে আরও বাড়বে বলেও মনে করেন অধ্যাপক সেলিম রায়হান।
এসব বিষয়ে ‘বিব্রত’ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, “এই প্রশ্ন কেন উঠছে সেটা আমি বুঝতে পারছি না।” সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একে অপরের পরিপূরক বলেও দাবি তার। তার ভাষায়, “সরকারের রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”
ব্যাংক লুটপাট তদন্তে নেই দুদক
ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও প্রভাবশালীদের এড়িয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত, ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীসহ ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের বিষয়ে তারা কিছুটা তৎপরতা দেখালেও সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিষয়ে নীরব। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী মাহবুবুল হক চিশতী আর মহীউদ্দীন খান আলমগীর উভয়ই এ জালিয়াতিতে সরাসরি জড়িত। ব্যাংকটির গ্রাহকের ঋণের ভাগ নিয়েছেন তারা। আর এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটি গত বছর থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। সেই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে সম্প্রতি মাহবুবুল হক চিশতী, তার পরিবারের ৫ সদস্য, ব্যাংকের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে দুদক। কিন্তু এ তালিকায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নাম নেই। এর আগে বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম এলেও দুদকের করা ৬১ মামলার কোনোটিতেই বাচ্চুর নাম আসেনি। আসেনি পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্যের নামও। সম্প্রতি আদালতের নির্দেশে বাচ্চুকে শুধুমাত্র কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সংস্থাটি।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করা যায় না। তাই তাকে বাদ দিয়ে কিছু হলে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। এ ব্যাংকটির জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই যেন আংশিক তথ্যের ওপর ভিত্তি না করা হয়, সেটাই দেশবাসী আশা করে।’
নির্বাচনের বছর : অর্থ পাচারের সুযোগ বাড়বে
দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনী বছরে প্রকৃত উদ্যোক্তারা নানা অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগেও খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাতে বাড়তি অর্থ মূল্যস্ফীতি ঘটাবে বলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা। পাশাপাশি অর্থ পাচারেরও সুযোগ বাড়বে। কারণ, নির্বাচনের বছরে এমনিতেই অর্থ পাচার বাড়ে। সুতরাং ব্যাংক খাতে নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব দেশই ব্যাপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও আলাপ-আলোচনা করে থাকে। যদিও ব্যাংকিং খাতে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কোন রকমের আলাপ-আলোচনা না করে ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে মুদ্রানীতি নিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনাও ব্যতিক্রমী। ব্যাংক মালিকদের চাপে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনায় বিশ্লেষকরা অত্যন্ত বিস্মিত। তারা মনে করছেন, এর পেছনের কারণ অর্থনীতি নয়, বরং রাজনৈতিক। মূল কারণ ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়া। ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়াই বড় উদ্দেশ্য।
বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কয়েকটি কাজ আছে। যেমন মুদ্রা সরবরাহ ঠিক রাখতে সহায়ক মুদ্রানীতি প্রণয়ন, ব্যাংক পরিদর্শন, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ইত্যাদি। এই কাজগুলো কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন ও যথাযথভাবে করতে না পারলে এ প্রতিষ্ঠান রাখা বা না রাখা সমান কথা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের ব্যাংকিং খাত লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হলো, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে লাখো কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কী ভূমিকা রেখেছে? এমন প্রশ্ন তুলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে সব নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুনের বিরুদ্ধে গিয়ে লুটেরাদের ব্যাপক সুযোগ করে দিয়েছে। কার্যত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কতিপয় কর্মকর্তা রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে অনৈতিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এর পর সব ব্যাংকের ধারাবাহিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে সমর্থন দিয়ে অকার্যকর হয়ে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিলুপ্ত ঘোষণার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
আমানতকারীদের কী হবে
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকের মোট মূলধনের ৯০ শতাংশই আমানতকারীদের। ১০ শতাংশের মালিকানা বিএবির সদস্যদের। কিন্তু তাদের হাতে আছে আলাদিনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ, যার নাম রাজনৈতিক প্রভাব। চাওয়ামাত্রই সব মেলে। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই এখানে। অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সিআরআর-এসএলআর রাখার অর্থ হলো আমানতকারীদের এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত আছে। আমানতকারীদের স্বার্থেই তা করা হয়। অথচ নির্বাচনের বছরে এসে সরকার গুরুত্ব দিল ১০ শতাংশ মালিকদের স্বার্থ। ভোটার হিসেবেও আমানতকারীদের যেন কোনো মূল্যই নেই।
কেলেঙ্কারি লেখা যাবে না!
দেশে খেলাপি ঋণ বহু আগেই এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন সংকট প্রকট এখন। বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয় হয় অবস্থা। এর জন্য সরকারের কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতি, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের অব্যাহত সুবিধা দেওয়া এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া।
এসবের মধ্যেই ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি আবদার করেছে, ব্যাংক কেলেঙ্কারির সংবাদ গণমাধ্যমে লেখা যাবে না। অর্থমন্ত্রীকে তারা এ নিয়ে লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছে। ব্যাংক খাত নিয়ে নেতিবাচক লেখালেখি বন্ধ করার জন্য আলাদা একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের এ আবদার ইতিহাসে লিখে রাখার মতো বলে মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের।
ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে দুর্নীতি এবং অনিয়মের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে বিএবির প্রস্তাবকে ‘অযৌক্তিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ ধরনের প্রস্তাব মেনে নেওয়া হলে তা ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের সুরক্ষা দেবে বলে মনে করে টিআইবি। এ প্রস্তাবকে ‘পশ্চাদমুখী’ ও ‘নিবর্তনমূলক’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠনটি। গত ২ এপ্রিল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সংবাদ প্রকাশ থেকে সংবাদমাধ্যমকে বিরত রাখার জন্য ব্যাংক রিপোর্টিং অ্যাক্ট করার সুপারিশ করেছে বিএবি। প্রস্তাবটি শুধু উটপাখিসম আচরণের বহিঃপ্রকাশই নয়, এটি ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতির তথ্য গোপন রেখে এসবের সুরক্ষা দেওয়া ও আরো বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির অপপ্রয়াস। কোনো অবস্থায়ই এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বেসরকারি হলেও ব্যাংকিং খাত বাস্তবে জনগণের অর্থের ওপর নির্ভরশীল বিধায় এ খাতের ইতিবাচক সংবাদের পাশাপাশি দুর্নীতি, অনিয়মসহ সব ধরনের তথ্য জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। তথ্য প্রকাশে প্রতিরোধক তৈরি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তার করার কোনো অধিকার জনগণ ব্যাংক মালিকদের দেয়নি।’
ব্যবসায়ীরাও ক্ষুব্ধ
দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা বর্তমানে ভালো নয় বলে মন্তব্য করেছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, তারল্যঘাটতি দূর করতে ব্যাংককে অর্থ দিলে দুর্নীতিকেই উৎসাহ দেওয়া হবে। তার ভাষায়, ‘ব্যাংক খাতের অবস্থা বর্তমানে ভালো নয়। আমরা ব্যবসা করি, নিজেরাও বুঝি। অনেক ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হয়। আমরা জানি, অনেক ব্যাংকের অবস্থাই খারাপ।’ ব্যাংক খাত নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা করতে অনুরোধ করেন তিনি।
তবুও নতুন ব্যাংকের তোড়জোড়
অর্থ সংকটের কারণে সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এমন অবস্থার মধ্যেই লাইসেন্স পাওয়ার জন্য তোড়জোড় অব্যাহত রেখেছেন নতুন দুই ব্যাংকের উদ্যোক্তারা। সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালের শেষ দিকে ‘বাংলা ব্যাংক’ ও ‘পিপলস ব্যাংক’ দুটিকে লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সুপারিশের পর গত ডিসেম্বরে এর চূড়ান্ত অনুমতি দেওয়া হয়। সরকারের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক লাইসেন্স পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে নতুন এই ব্যাংক দুটি।
তথ্যমতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্তমানে নতুন দুই ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সরকারের নীতিগত পর্যায়ে অনুমোদিত ব্যাংক দুটির মধ্যে ‘বাংলা ব্যাংক’-এর উদ্যোক্তা হচ্ছেন বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সহ-সভাপতি এই ব্যবসায়ী নেতা বর্তমানে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালক এবং বেসরকারি মেঘনা ব্যাংকেও তার শেয়ার রয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অপরদিকে ‘পিপলস ব্যাংক’-এর উদ্যোক্তা আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহ-সভাপতি এমএ কাশেম। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ নিবাসী এই ব্যবসায়ীর হোটেলের ব্যবসা রয়েছে। প্রথমে ব্যাংকটি ‘পিপলস ইসলামি ব্যাংক’ নামে আবেদন করা হলেও পরে ‘ইসলামি’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
এর বাইরে বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদন পাচ্ছে ‘পুলিশ ব্যাংক’। এ ছাড়াও গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ‘সিটিজেন ব্যাংক’ নামে একটি ব্যাংককে লাইসেন্স প্রদানের অনুমতি চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুপারিশ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর উদ্যোক্তা মোহাম্মদ ইকবাল একজন গার্মেন্টস মালিক বলে জানা গেছে।
বর্তমানে দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা হচ্ছে ৫৭টি। নতুন তিনটি ব্যাংক অনুমোদন পেলে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৬০-এ। চলমান ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার জন্য যখন দৌড়-ঝাঁপ চলছে, ঠিক তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে ৮০টির বেশি নতুন ব্যাংকের তদবির চলছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
(সাপ্তাহকি শীর্ষকাগজে ১৬ এপ্রিল ২০১৮ প্রকাশতি)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন