ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলায় প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে ১৪ বছরের এক ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। ২১ মে, সোমবার সকালে এ ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে সোমবার দুপুরের দিকে ফুলবাড়ীয়া থানায় একটি মামলাও করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রীর অভিভাবকরা। তবে ছাত্রীকে কোনো ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়েই বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ।
আইনজীবীরা বলছেন, এতে করে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মামলা নেওয়ার পর মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করানোটা পুলিশের আসামিকে বাঁচানোর প্রয়াস।
ধর্ষণের চেষ্টায় অভিযুক্ত একজনের নাম মো. মামুন (২০)। তিনি ফুলবাড়িয়ার ধামর দক্ষিণপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল আজিজের ছেলে। অভিযোগ থাকা আরেকজনের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। মামলার কপি অনুযায়ী, ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
স্থানীয় ও ভুক্তভোগীর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার জন্য সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয় ভুক্তভোগী ছাত্রী। ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে এলাকার এক বাঁশ বাগান পার হওয়ার সময় দুজন তার মুখ চেপে ধরে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যান। এ সময় তারা ছাত্রীকে ধর্ষণের পাশাপাশি শারীরিকভাবে অত্যাচার করেন। এর এক সপ্তাহ আগে তারা বাড়িতে গিয়ে ওই ছাত্রীর ক্ষতি করার হুমকিও দিয়ে আসেন।
ওই ছাত্রী যখন নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়ি ফিরছিল, তখন দেখা হয় ওই এলাকারই হাফেজ হেলালউদ্দিনের সঙ্গে। ঘটনা সম্পর্কে হেলাল প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমি বইসা ছিলাম। আমার সামনে দিয়াই লাঞ্ছিত হয়ে কানতে কানতে যাইতাছিল ও। ওই সময় ও অনেক কাঁপতেছিলও। ওর অবস্থা দেইখ্যা আমি জিগাইছি, কী অইছে তোমার? আমারে আর ও কিছুই কইছে না। দৌড় দিয়া বাড়িতে আইসা পড়ছে।’
আশপাশের মানুষের সঙ্গে আলোচনা এবং ওই ছাত্রীদের বাড়িতে গিয়ে ও তার সঙ্গে কথা বলে পুরো বিষয়টা জানতে পারেন হেলালউদ্দিন। ওই ছাত্রীর ওপর অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে হেলালউদ্দিন আরও বলেন, ‘কোচিংয়ে যাওয়ার সময় দুইজন ছেলে ওই ছাত্রীকে টাইন্যা নিয়ে জংলার ভিতরে ঢুইক্যা পড়ে। ওই জংলা (বাঁশঝাড়) অনেক বড়। তার গায়ে টাচ (ধরা) কইরা, বুকে-টুকে অইত্যাচার করে। বুকও জহম কইরা ফেলাইছে। মুখের মধ্যে চিইপ্যা, মুখ ছিঁইড়া ফেলাইছে আরকি। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঁচড়, ছুইল্যাটুইল্যা গেছে। শরীরে থাকা কাপড়-চোপড় ছিঁইড়া ফেলাইছে, বোরকা ছিঁইড়া ফেলাইছে। দুইডা ছেলে ধরছে তারে।’
ভুক্তভোগী ছাত্রী জানায়, যে দুজন তাকে নির্যাতন করেছে, তাদের মুখ চিনলেও নাম-পরিচয় বিস্তারিত জানত না। ওই দুজনের মধ্যে একজন দুই-তিন দিন ধরে পেছন পেছন আসতেন। এর আগে সেই ছেলে তার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকত। কিন্তু কিছু বলত না। সপ্তাহখানেক আগে ওই ছেলেসহ আরও দুই-একজন বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যায়।
ভুক্তভোগীর খালা প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আগে থেকে আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো শত্রুতা ছিল না। তাদের বাড়ির বাইডাক (বাড়ির পাশ দিয়ে) দিয়া আমরা চলাফেরা করি। ইস্কুল, কলেজে যেতে হয় তাদের বাড়ির বাইডাক দিয়াই। সবসময় তাকাই থাকত, কিন্তু কোনো কিছু বলত না।’
৩ নম্বর কুশমাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শামছুল হক বলেন, ‘বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। তবে আমি খোঁজখবর নিচ্ছি।’
ফুলবাড়ীয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলা নেওয়া হয়েছে। মেয়েটার মাসিক (ঋতুস্রাব) ছিল, যে কারণে ধর্ষণ করতে পারে নাই। কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলছে, বুকে হাত দিছে। আমরা একজনের পরিচয় জানতে পেরেছি। তাকে আমরা ধরার চেষ্টা করছি।’
ফুলবাড়ীয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নীরা তরফদার প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়টি আমি জানি। তারা আমার কাছে এসেছিল। সবকিছু শোনার পর আমি তাদেরকে থানায় পাঠিয়েছি এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।’
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হিসেবে দায়িত্ব পড়েছে উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল মান্নানের ওপর। বিকেল ৪টা ৪৮ মিনিটে তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘মামলা রেকর্ড (নথিভুক্ত) হয়েছে, কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় কাগজ আমার কাছে আসেনি। ভুক্তভোগীর কাছ থেকে পাজামা, সেলোয়ার-কামিজ, বোরকা পেয়েছি। কিন্তু কোনো ধরনের স্পার্ম (বীর্য) পাইনি। এটা ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে। তাই মামলাও হয়েছে ধর্ষণের চেষ্টায়।’
ভুক্তভোগী সশরীরে গিয়ে থানায় মামলা করলেও তার কোনো ধরনের মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। কেন ভুক্তভোগীর মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো না জানতে চাইলে আইও আব্দুল মান্নান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। কেন হলো না, আমি জানি না। আপনি অফিসারের সাথে কথা বলতে পারেন।’
এর পরপরই মান্নান বলেন, ‘ওইটার আইও আমারে দিছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার কপি পাইনি। ধর্ষণের চেষ্টা মামলায় সুরতহাল হয় না, ডাক্তারের কাছে পাঠাতে হবে তাকে। আগে মামলার কপি পাই, পরবর্তীতে জানা যাবে। কাল ফোন দিয়েন।’
পুলিশ কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী ছাত্রীকে মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়ে আসামিদের রক্ষার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘মামলা হওয়ার পর প্রথমে মেডিকেল টেস্টের জন্য থানা থেকে পাঠিয়ে দেবে পুলিশ। কিন্তু পুলিশ এটা না করায় ধর্ষণের আলামত নষ্ট করার প্রয়াস চলছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল টেস্ট করলে আলামত সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। এই নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে মেডিকেল টেস্ট করা হলে আলামত সুস্পষ্ট হবে না, অপষ্ট হয়ে যাবে। তখন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের জন্যও ধর্ষণ হয়েছে কি না, এটা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।’
এহসানুর রহমান আরও বলেন, ‘ফুলবাড়ীয়ার ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তার উচিত ছিল মামলা নেওয়ার সাথে সাথে মেডিকেল টেস্টের জন্য পাঠানো। আলামতে যদি পাওয়া যেত ধর্ষণ করা হয়নি, তখন ধর্ষণের চেষ্টা মামলা দেওয়া যেত। এখানে আসামিদেরকে রক্ষা করার একটা চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে এটা ধর্ষণ হয়েছে কি না, সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই। এটা বলার অধিকার পুলিশ রাখে না।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন