দুই দিনের সফরে আজ শুক্রবার সকালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন, বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ এবং কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি.লিট) উপাধি গ্রহণ তাঁর সফরের উদ্দেশ্য হলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠক সফরের গুরুত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে তুলেছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আজ শান্তিনিকেতনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বহুল প্রত্যাশিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও রোহিঙ্গা সংকট বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশে এ বছরের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে ভারতে জাতীয় নির্বাচন আগামী বছরের প্রথমার্ধেই। এমন প্রেক্ষাপটে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ অগ্রগতি প্রত্যাশা করছে।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দৃশ্যত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা ভেস্তে যায়। তখন থেকেই ভারত যত দ্রুত সম্ভব তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে অঙ্গীকারের কথা বলে আসছে। বিশেষ করে, গত বছরের এপ্রিলে নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন যে শুধু তাঁর সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারই তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যু সুরাহা করতে পারে।
ঢাকার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের মেয়াদেই তিস্তা চুক্তি সই হলে তা হবে একটি বড় অর্জন। বিষয়টি ভারতের কাছে বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ তুলে ধরেছে।
ভারতীয় সূত্রগুলো বলছে, তিস্তা চুক্তিতে এখনো বড় বাধা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা সমীকরণে মমতার সঙ্গে মোদির দূরত্ব আরো বেড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, ভারতে তিস্তা ইস্যুটি রাজনৈতিক মহলেই আছে। তারা দিকনির্দেশনা দিলেই কূটনীতিকরা কাজ শুরু করবেন। মমতা আপত্তি তুলে নিলে তিস্তা চুক্তি যেকোনো সময়ই সম্ভব। তবে মমতা আপত্তি তুলবেন কি না এবং মোদি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারবেন কি না সেদিকেই সবার দৃষ্টি থাকবে।
ভারতীয় কূটনীতিকরা দাবি করেন, তিস্তা চুক্তি না হলেও স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে পানি পাচ্ছে বাংলাদেশ।
ভারতীয় কোনো কোনো কূটনীতিকের আশঙ্কা, বর্তমানে বাংলাদেশ তিস্তার যে পরিমাণ পানি পাচ্ছে, চুক্তি হলে তার চেয়েও কম পাবে। তবে বাংলাদেশি কূটনীতিকরা বলেছেন, পানি কম বা বেশি পাওয়া যাবে—এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো চুক্তি সই করা।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের আরো জোরালো ভূমিকা চায় বাংলাদেশ। দেশের কূটনীতিকরা মনে করেন, এ ইস্যুতে ভারতের অবস্থান আগের চেয়ে বদলেছে। তবে ভারতীয় কূটনীতিকরা বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁদের অবস্থান প্রায় অভিন্নই আছে। শুরুর দিকে বিষয়টি বাংলাদেশের বোঝার ভুল ছিল। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত আছে। তাই মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে ভারত সমর্থন দেবে—ঢাকার এমন প্রত্যাশা দিল্লির কাছে যৌক্তিক ছিল না। ভারত বরং দুই দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সংকট সমাধানে কাজ করছে।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত বুধবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি চাইলে আলোচনা হতে পারে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ভারতের তৎকালীন সরকারের জোরালো সমর্থন ছিল। ওই বছরই ভারতে বিজেপি সরকার গঠনের পর নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনকে এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে ভারত। তবে এ দেশে নির্বাচন-পূর্ববর্তী অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির দিকেও ভারতের নজর রয়েছে। ভারত তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশে অব্যাহত গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা দেখতে চায়। বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমপরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বেড়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ গত অক্টোবর মাসে ঢাকা সফরের সময় বলেছেন, ভারতের কাছে প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশই সবার আগে।
জানা গেছে, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার আজকের বৈঠকে ভারতের প্রতিশ্রুত ঋণের অর্থ ছাড়, কানেকটিভিটিসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব বিষয়েই আলোচনা হবে। প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে কলকাতায় পৌঁছবেন। প্রায় একই সময় নয়াদিল্লি থেকে কলকাতায় আসবেন মোদি। এরপর তাঁরা হেলিকপ্টারে করে শান্তিনিকেতনে পৌঁছবেন। শেখ হাসিনা শান্তিনিকেতনে ভারতের কেন্দ্র পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীতে ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন করবেন। ওই অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
শেখ হাসিনা আজ বিশ্বভারতীতে নিয়মিত সমাবর্তনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন। আগামীকাল শনিবার পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সমাবর্তনে শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করা হবে। নজরুলের সৃষ্টি-কর্ম নিয়ে গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনসহ গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীকে ওই উপাধি দেওয়া হচ্ছে। কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সমাবর্তনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপস্থিত থাকবেন।
আজ সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ এবং বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের চিত্র তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের এ দেশে আরো বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করবেন। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এবং ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের কিংবদন্তি বাঙালি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। সফর শেষে আগামীকাল রাতে প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় ফিরবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন