সৌদিতে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারীদের কমবেশি প্রতি মাসেই দেশে ফিরছেন। গত এক বছরে দেশে ফিরেছেন প্রায় এক হাজার নারী। এদের মধ্যে অধিকাংশই দেশে ফিরে অভিযোগ করেছেন, সেখানে তাদের শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়েছিল। নির্যাতন সইতে না পেরে তাদের কেউ কেউ বাসাবাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। আবার কেউ নিজের ইচ্ছায় মালিকের হাতে-পায়ে ধরে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করেন।
নির্যাতন সইতে না পেরে কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছেন। গত তিন মাসে নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে দেশে ফিরেছেন ছয় নারী। সেই ছয় নারীর পরিবারের সঙ্গে প্রিয়.কমের এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে।
তাদের পরিবার জানায়, বিদেশ-ফেরত ওই ছয় নারী এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। আবার কেউ কেউ কিছুটা সুস্থ হলেও এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তবে তাদের চিকিৎসার ভার বহন করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওই নারী শ্রমিকদের দেশে আনার পর প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগ। এমনকি তারা প্রতিনিয়ত তাদের খোঁজখবরও রাখে। কিন্তু দেশে ফেরত আসা মানসিক ভারসাম্যহীন ছয় নারীর পরিবারের সঙ্গে তাদের ব্যাপারে সরকার বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। এমনকি তাদের কোনো ধরনের সাহায্য বা সহযোগিতাও করা হয়নি বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী নারীদের পরিবার।
এদিকে সেই নারীদের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসার ব্যয়ও প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বহন হচ্ছে বলে দাবি করেছেন মন্ত্রণালয়টির সচিব নমিতা হালদার।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি ঝর্ণা
ঝর্ণা বেগম (৩৭)। গত ২১ মার্চ দেশে ফিরেছেন তিনি। কিন্তু এখনো সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেননি। আনমনা হয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কেউ কিছু বলে বসলেই চিৎকার আর চেঁচামেচি করেন। অনেক সময় হাতের কাছে যা পান, তা দিয়ে অনেকের ওপর হামলাও করে বসেন। দেশে ফেরার পর থেকে এই অবস্থা ঝর্ণার।
অসুস্থ ঝর্ণার ব্যাপারে এসব তথ্য জানিয়েছেন তার ভাই লোকমান হোসেন। তবে অসুস্থ বোনের চিকিৎসা ব্যয় বহনে হিমসিম খেতে হচ্ছে ভাইকে। বর্তমানে ঝর্ণার সুস্থতায় আরও চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও টাকার অভাবে তা করানো সম্ভব হচ্ছে না তার দরিদ্র পরিবারের পক্ষে।
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার আড়ালি গ্রামের আব্দুল হক চানের মেয়ে ঝর্ণা। সৌদিতে যাওয়ার সময় প্রায় পাসপোর্ট ও ট্রেনিং বাবদ ২৫ হাজার টাকা খরচ করেন তিনি। দালাল তাকে ভালো কাজ দেবে বলে সে দেশে নিয়ে যায়। কিন্তু যাওয়ার পরই পুরো উল্টো চিত্র দেখতে পান ঝর্ণা। যে বাসায় ঝর্ণা কাজ করত সেখানে তাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। একসময় মানসিক ভারমাস্য হারিয়ে ফেলেন ঝর্ণা। পরে মাত্র আড়াই মাসের মাথায় দেশে পাঠানো হয়। তবে সে সময় দেশে তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়। বিমানবন্দরে ফেরার পর তিনি প্রায় ২৪ ঘণ্টা ইমিগ্রেশনের ওদিকেই ছিলেন। পরে বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ঝর্ণাকে উদ্ধার করে। এরপর ঝর্ণাকে উদ্ধার করে ব্র্যাক তাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে তার ভাইয়ের কাছে তুলে দেয়।
ঝর্ণার ভাই লোকমান জানান, দেশে ফেরার তিন দিন পর ঝর্ণার দেশে আসার খবর পান তিনি। এরপর ঢাকায় গিয়ে একটি হাসপাতাল থেকে গ্রামে নিয়ে আসেন। আসার দিন তিনি তার মেয়েকে ও পরিবারের কাউকেই চিনতে পারতেন না। প্রতিবেশীদের মারধর আর হাত ধরলেই গালিগালাজ করতেন। ঝর্ণার সুস্থতার জন্য তাকে নরসিংদী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। আর তার চিকিৎসা বাবদ প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ টাকার পুরোটাই তিনি ঋণ নিয়ে চালিয়েছেন।
লোকমান বলেন, ‘বোনটা তার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সেখানে গেল কিন্তু কিচ্ছু লাভ হইল না। উল্টা পাগলি হইয়া দেশে আসলো। আর দেশে আসার পার সরকার তো কোনো খোঁজ নিল না। এমনকি যোগাযোগও করল না। আমারও তো পরিবার আছে। ঋণ নিয়ে কিছুদিন চিকিৎসা করালাম। কিন্তু এখন তো টাকার অভাবে বোনটার চিকিৎসাও করাতে পারছি না।’
টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না মনোয়ারার
চলতি বছরের জানুয়ারির কথা। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার রাজনগর গ্রামের সবুর মুন্সির মেয়ে মনোয়ারা বেগম (৩০)। সৌদিতে গিয়েছিলেন গৃহকর্মী হিসেবে। একটি বাসায় কাজও নিয়েছিলেন। কিন্তু বাসার মালিকের নির্যাতনে আর থাকতে পারেননি। পরে তার আশ্রয় হয় বাংলাদেশি আশ্রয় কেন্দ্রে। গত ২০ মে দেশে ফিরেছেন মনোয়ারা।
দেশে ফেরার দিন রাতে বিমানবন্দরে তার সঙ্গীরা বুঝতে পারেন মনোয়ারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। সেদিন ব্র্যাকের সহায়তায় তাকে রাজধানীর একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার দিন চিকিৎসার পর তার খালাতো ভাইয়ের কাছে তুলে দেয় ব্র্যাকের অভিবাসন নিয়ে কাজ করা কর্মীরা। এরপর থেকে সেই খালাতো ভাইয়ের বাসাতেই তার আশ্রয় হয়েছে।
মনোয়ারার খালাতো ভাই বিল্লাল হোসেন প্রিয়.কমকে জানান, সৌদি যাওয়ার সময় মনোয়ারা সুস্থ ছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরে আসেন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এরপর কিছুদিন চিকিৎসাও হয়েছে। প্রায় মাস খানেক হতে চললেও তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। গত এক মাসে তার পেছনে চিকিৎসাবাবদ প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর পুরোটাই তিনি খরচ করেছেন। তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বা সরকারের পক্ষ থেকে মনোয়ারার এখনো কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। জানতেও চাওয়া হয়নি তার শারীরিক অবস্থা।
দুঃখ করেই বিল্লাল হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সৌদিতে গেছিল। বাসার মালিক নাকি তারে মাথায় মারছিল। আর কিচ্ছু কইতে পারে না। মাঝে মাঝে কথা কয় আবার চুপ মাইরা যায়। পাড়ার লোকজনরে দেখলেই গালিগালাজ করে। কই সরকার তো তারে পাঠাইল কিন্তু কোনো খোঁজ তো নিল না। টেকা-পয়সাও দিল না। বইনটা অভাগা।’
ব্র্যাকের পক্ষ থেকে মনোয়ারার চিকিৎসা চালানোর জন্য বলা হয়েছে কিন্তু তার খালাতো ভাইয়ের স্বল্প আয়ে সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। বাকি চিকিৎসা করাতে না পারলে মনোয়ারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান বিল্লাল হোসেন।
এখনো সুস্থ হননি মমতাজ
মমতাজ সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার রুদ্রপুর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে। স্বামী না থাকায় এক মাত্র ১২ বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকতেন বাবার বাড়িতে। সন্তানকে মানুষ করবেন বলে গত বছরের মাঝামাঝি পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদিতে। স্বপ্ন ছিল গৃহকর্মীর কাজ করে দেশে টাকা পাঠাবেন। সে টাকায় সন্তানকে মানুষ করবেন তিনি। কিন্তু তার সে স্বপ্ন কয়েক মাস না যেতেই ফিকে হতে শুরু করে।
প্রায় ৯ মাস সৌদির একটি বাসাবাড়িতে কাজ করেন। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের বেতন পান। বাকি বেতনের টাকা চাইতে গিয়েই তিনি বাসার মালিকের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন। মারধরের কারণে সেখানেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরে তাকে উদ্ধার করে গত মাসে ২০ মে বাংলাদেশে আনা হয়। দেশে ফেরার পর থেকেই মানসিক ভারাসাম্যহীন মমতাজ পরিবারের কাউকেই চিনতে পারছেন না।
মমতাজের ছোট ভাই আফজাল হোসেন জানান, মমতাজের পেছনে এ পর্যন্ত চিকিৎসা বাবদ প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পুরো টাকাই ধার-দেনা করে তারা খরচ করেছেন। তবে সরকার বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। এমনকি কোনো টাকা-পয়সা সাহায্য দেওয়া হয়নি।
আফজাল হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘যদি ওরে সৌদির অফিস থাইক্যা তিন মাসেরও বেতন দিত, তা হইলে ভালো হইত। কিন্তু সেটাও দেয়নি। দৈনিক বাংলার মোড়ের একটি অফিস তাকে বিদেশ পাঠাইছিল। তারাও তো এখন আর কোনো খোঁজ নেয় না।’
আকলিমার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে তার ছেলে
ফরিদপুর কোতয়ালি থানার বাকন্দা গ্রামে আকলিমা বেগম (৪৫)। স্বামী না থাকায় তিন সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই সৌদি গেয়েছিলেন। কিন্তু মাস ছয়েক থাকার পরই তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়। পরে তার আশ্রয় হয় বাংলাদেশি আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখান থেকে তাকে ২১ মার্চ ব্র্যাকের সহায়তায় দেশে ফেরত আনা হয়। এরপর রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে পরিবারের কাছে তুলেও দেওয়া হয়েছিল তাকে।
আকলিমার ছেলে আজিজুল ইসলাম জানান, তার মা বিদেশ যাওয়ার সময় সুস্থ ছিলেন। কিন্তু বিদেশ থেকে ফেরত আসার পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। তবে তার এখনো চিকিৎসা চলছে।
আকলিমার ছেলে পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। কিন্তু তারপরও তিনি তার মায়ের চিকিৎসায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। তবে সংসারের খরচ যোগানো এবং মায়ের চিকিৎসা—সব মিলে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তার মা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় আকলিমা দেশে ফেরার পর থেকে কোনো ধরনের খোঁজখবর নেয়নি। এমনকি তার চিকিৎসায় কোনো টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেনি বলেও জানান ছেলে আজিজুল।
আকলিমা, ঝর্ণা, মনোয়ারা এবং মমতাজের মতোই অবস্থা ফরিদপুরের আমেনা বেগমেরও। তিনিও এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তবে চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় খোঁজখবর নেয়নি বলে জানিয়েছে তার পরিবার।
প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সচিবের বক্তব্য
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সৌদি থেকে গৃহকর্মী ফেরত বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলেছি। এ বিষয় নিয়ে আর কোনো ধরনের কথা বলতে চাই না। তাদের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে। সচিবের এমন কথার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। সচিবের এমন কথায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরাটা এটাকে চরম মিথ্যাচার বলেছেন।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
আমরা সৌদি প্রবাসীরা কত শত চিতকার করেছি মহিলা গৃহকর্মী না পাঠাতে- না আসতে, কেউ শোনেনি!! বরং উল্টো অনেক মন্দকথা শুনিয়ে দিয়েছে!! তবে এখন এতো কান্নাকাটি কেন?? এসব তাদের নিজনিজ কর্মফল, অন্যকে দোষারোপ করে লাভ কী??
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন