পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে মূল অভিযুক্তসহ দুই আসামির স্বীকারোক্তির পরও অপপ্রচার পিছু ছাড়ছে না রাজধানীর বনানীতে ধর্ষণের শিকার দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর। ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দুই ছাত্রীর ছবি ছড়িয়ে দিয়েছে একটি চক্র। এসব ছবিতে আপত্তিকর মন্তব্যও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দুই ছাত্রীর একজন অভিযোগ করেছেন, প্রভাবশালী আসামিরা গ্রেফতার এড়াতে না পেরে এখন লোকজন দিয়ে তাদের ছবিতে আপত্তিকর মন্তব্য জুড়ে তা ভাইরাল করে দিচ্ছে। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছে। এদিকে মামলার অন্যতম আসামি নাঈম আশরাফ নামধারী আবদুল হালিম পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করলেও পুরো ঘটনার জন্য দায়ী করছে প্রধান আসামি সাফাতকে। অবশ্য নিজের অন্যসব অপকর্ম ও প্রতারণার কথা স্বীকার করছে সে। সে সব কাহিনী শুনে বিস্মিত হচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারাও।
গত বুধবার মুন্সীগঞ্জ থেকে গ্রেফতারের পর নাঈমকে সাতদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
ঘটনার শিকার এক ছাত্রী জানিয়েছেন, প্রভাবশালী আসামিদের লোকজন এখন তাদের ‘খারাপ’ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের ছবি বিকৃত করে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে অশ্লীল কথা লিখছে। গত বৃহস্পতিবার ‘অন্তরা ইসলাম’ নামের একটি আইডি থেকে তাদের ছবি পোস্ট করে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়।
মামলার বাদী তরুণী সমকালকে বলেন, আজেবাজে মন্তব্য লিখে ভাইরাল করে দেওয়া ছবিগুলো তাদের ফেসবুক থেকেই নেওয়া হয়েছে। এরপর সেগুলো ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে চান।
গত ৬ মে ওই তরুণী বনানী থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। অভিযোগে বলেন, ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলে অস্ত্রের মুখে তারা ধর্ষণের শিকার হন। মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ তাদের হোটেল কক্ষে নিয়ে পাশবিকতা চালায়। মামলায় ওই দুজন ছাড়াও ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী রহমত আলীকে আসামি করা হয়। এরই মধ্যে পুলিশ পাঁচ আসামিকেই গ্রেফতার করেছে। সাফাত ও সাদমান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বিল্লাল ও রহমত আলীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ ওই মামলাটির তদন্ত করলেও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এতে সহায়তা করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হালিম জিজ্ঞাসাবাদে ওই রাতে হোটেল কক্ষে কী হয়েছিল তার বিবরণ দিয়েছে। তবে সে সব কিছুতেই নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। সে দাবি করছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করতে গিয়ে অপর আসামি সাদমান সাকিফের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে সাকিফের মাধ্যমেই সাফাতের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। সাফাত ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান হওয়ায় কৌশলে সে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। ওই রাতে সাফাত তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দুই তরুণীসহ অনেককেই আমন্ত্রণ জানায়। সে নিজেও সাফাতের আমন্ত্রণে হোটেল রেইনট্রিতে যায়। সেখানে যা কিছু হয়েছে সাফাতের নির্দেশে হয়েছে।
পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, মামলার অন্যতম দুই আসামি সাফাত ও সাদমানের জবানবন্দিতে ঘটনার সঙ্গে হালিমের সংশ্লিষ্টতার কথা এসেছে। সে নিজে ঘটনার কথা স্বীকার করলেও ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, হালিমকে শুক্রবার কিছু সময়ের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করেই মনে হয়েছে, সে অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। বড় ধরনের প্রতারক।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাসঙ্গিকভাবেই নাঈম আশরাফ ওরফে হালিমের নানা কর্মকাণ্ডের বিষয় উঠে আসে। তবে পুলিশের মূল তদন্তের বিষয় ধর্ষণ মামলাটি। আপাতত সেই কাজেই উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগকে তারা সহায়তা দিচ্ছেন। দুই তরুণীর বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে কীভাবে সমাজের উঁচুস্তরের লোকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়েছে সে বিষয়েও কথা বলেছে হালিম। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থেকেই তার প্রতারণার হাতেখড়ি হয়। ২০০৩ সালে স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেও রক্ষা পেয়ে যায়। তবে তার প্রতারণা থেমে থাকেনি। এরপর ঢাকায় এসেও প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িয়ে পড়ে সে। কয়েক বছর আগে প্রতারণার মাধ্যমে পুরান ঢাকার এক ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের হয়ে দায়িত্ব পালনের সুবাদে প্রভাবশালীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এরপর নিজেই মালিক বনে যায় ই-কমার্স নামের একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের। ওই প্রতিষ্ঠানের নামে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সে। পাশাপাশি ধনাঢ্য তরুণীদের বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিজের তোলা ছবি দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলেও লোকজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় হালিম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন