বাজারে চালের দামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের মন্ত্রীরা দায়ী করছেন বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের। পক্ষান্তরে বিএনপি বলছে, এর জন্য সরকারের অদক্ষতা ও দুর্নীতিই এর জন্য দায়ী। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক কারণ দেখছেন না তারা। তাদের মতে, বন্যা পরবর্তী সময়ে চালের সরবরাহ ঠিক রাখার উদ্যোগ নেয়া হলে এখন বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করতো না।
চালের দাম বৃদ্ধির জন্য বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের দায়ী করে শুক্রবারে এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, বিএনপিপন্থী কিছু ব্যবসায়ী ‘কারসাজি’ করে চালের দাম বাড়িয়েছে।
এর জবাবে পরের দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের ‘অদক্ষতা ও দুর্নীতির’ কারণে চালের দাম বেড়েছে।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ দেশের বেশ কয়েকটি হাওরে অকাল বন্যা দেখা দিলে চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। এ কারণে গত কয়েক সপ্তাহে চালের দাম অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে। বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। আর সরু (মিনিকেটসহ উন্নত মানের চাল) চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকায়।
সরকারি হিসেবে গত এক মাসে মোটা চালের দাম বেড়েছে আট শতাংশের বেশি, আর এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। একই সময়ে সরু চালের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
রোববার রাজধানীর হাতিরপুল বাজার ও কাওরান বাজার চালের আড়তে গিয়ে দেখা গেছে, নিম্নমানের মোটা চাল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকায়। আর স্বর্ণা, পাইজাম, চায়না ইরিসহ মোটামুটি ভালো মানের মোটা চাল পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৬ টাকায়, খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। আর মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মত সরু চাল পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৪ টাকা, খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, চাল নিয়ে রাজনৈতিক কথা কেন হচ্ছে জানি না। হাওরে বন্যার কারণে ফসল বিশেষ করে ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কিন্তু চাহিদা কমেনি। এ কারণে চালের দাম বাড়তে পারে।
যখন বন্যায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তখনই চাল আমদানির ওপর বিদ্যমান ২৫ শতাংশ শল্ক প্রত্যাহার করলে ব্যবসায়ীরা আমদানিতে উৎসাহ পেতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরফলে বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকতো। এছাড়া বন্যার পরই সরকারি উদোগে আমদানির পদক্ষেপ হলে চালের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়তো না। অনেক দেরিতে সরকার চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এই চাল বাজারে আসতে কিছু সময় লেগে যাবে।
এসব সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা সংকটকালে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামগুলোতে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার টন চাল মজুদ রয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫ লাখ ৯৩ হাজার ২০ টন।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান
চালের দাম বাড়ার বিষয়টি রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক কারণ বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, গত বছর কিছু সংকট দেখা দিয়েছিল চালের বাজারে। তখন সবাই ভেবেছিল বোরো মৌসুমে ধান উঠলে বাজারে ঘাটতি থাকবে না। দামও হাতের নাগালে থাকবে। কিন্তু হঠাৎ হাওরাঞ্চলে বন্যা ও বিভিন্ন অঞ্চলে ব্লাস্ট রোগে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব কারণে ধারণা করা হয়েছিল ১০ থেকে ১২ লাখ টন ধান কম উৎপাদন হবে। কিন্তু তার চেয়েও অনেক কম উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া সরকারি গুদামে চালের মজুদ দুই লাখ টনে নেমে এসেছে-বিভিন্নভাবে এসব খবর ছড়িয়ে পড়ায় চালের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তিনি বলেন, সরকার ১০ লাখ টন চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমদানি আরো বেশি করা দরকার। ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল কেনা হবে। অনেক দূরের দেশ ভিয়েতনাম থেকে চাল আসতে দেড় থেকে দুই মাস লেগে যাবে। ততক্ষণে বাজারে চালের দাম আরো বাড়বে। যার চাপ পড়বে ভোক্তার ওপর। এই জন্য প্রতিবেশী কোনো দেশ থেকে চাল এনে আপাতত সংকট মোকাবেলা করতে হবে।
“তবে আমি মনে করি এটা অর্থনৈতিক বিষয়। এখানে রাজিনীতি টেনে আনা উচিত নয়।”
চালের দাম বাড়ার পেছনে মিল মালিকরা কিছুটা দায়ী হলেও সরকারেরও ব্যর্থতা রয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। কাওরান বাজারে পাইকারি ব্যবসায়ী চাটখিল রাইস এজেন্সির মালিক বেলাল হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বৈশাখ মাসে ধানের দাম স্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাওরাঞ্চলে বন্যায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ধান নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে সরকারি গুদামে মজুদ কমে গেছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন মিল মালিকরা।
চাল নিয়ে রাজনীতি করাটা অযৗক্তিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, সব ক্ষমতার মালিক সরকার। তারা যদি বলে বিরোধী দলের (বিএনপি) কারণে চালের দাম বেড়েছে তাহলে বুঝতে হবে সরকারেরও দূর্বলতা রয়েছে। তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। এর দায়ভার তো তাদের ওপরই বর্তায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন