টানা কয়েকদিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ঠাঁকুরগাওসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মানবেতর জীবন যাপন করছেন বানভাসি মানুষ।
লালমনিরহাট: গেলো কয়েকদিনের বিরাজমান ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাটের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। শনিবার ভোর ৬টা থেকে দোয়ানী পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ও কুলাঘাট পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে এক লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। শনিবার ভোর ৬টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে ৫২ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। যা স্বাভাবিকের (৫২দশমিক ৪০) চেয়ে ২৫ সেন্টিমিটার উপরে। ব্যারেজের সবগুলো গেট খুলে পানির গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। ডালিয়া (দোয়ানী ব্যারেজ) পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের সহকারি কমিশনার সুজা উদ-দৌলা জানান, বন্যা কবলিত উপজেলাগুলোতে আগাম ত্রাণ মজুদ রয়েছে। সেখান থেকে বিতরণ করা হবে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক সফিউল আরিফ বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বন্যা কবলিত এলাকায় সার্বক্ষণিক খোঁজ নেয়া হচ্ছে। ত্রাণ বিতরণের প্রস্তুতি চলছে।
পঞ্চগড়: টানা তিনদিনের ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে পঞ্চগড়ের ৫ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি রয়েছে জেলার কয়েক লাখ মানুষ। বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি অসংখ্য পরিবার পাশের স্কুল কলেজ এবং খোলা মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন। জেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। দুর্গতদের সহায়তায় এখনো সরকারি বেসরকারি কোনো সংস্থা এগিয়ে আসেনি। তবে প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধিরা দুর্গত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছেন। জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মন্ডল জানান, তিনদিন ধরে ভারি বর্ষণে জেলার বিভিন্ন উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে গেছে। দুর্গত এলাকায় শুকনো খাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
সুনামগঞ্জ: গেলো কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ জেলার সবক’টি নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এখানকার ৬ উপজেলার ২শ’র বেশি গ্রামের প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা দু’দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও: টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জমিদারপাড়া, ডিসিবস্তী, জলেশ্বরী তলা, এসিল্যান্ডবস্তী, মুজিবনগড়সহ বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টাঙ্গন, শুকসহ বিভিন্ন নদীর পানি বেড়েছে যাওয়ায় শতশত ঘড়বাড়ি তলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় ঘড়বাড়ি ছেড়ে মানুষ ঠাই নিচ্ছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। এছাড়া জেলার পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল ও হরিপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বাড়ি ঘড়ে পানি ঢুকে পড়ায় মানুষ চরম সমস্যায় পড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে।
মৌলভীবাজার: টানা বৃষ্টিতে ফের মৌলভীবাজারে মনু ও ধলই নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা পানির কারণে মনু নদীর কুলাউড়ায় রেলব্রীজে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, মৌলভীবাজার শহরের চাঁদনীঘাট এলাকায় ১০ সেন্টিমিটার ও ধলই নদী কমলগঞ্জে ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পানি প্রচণ্ড গতিতে নামছে। যদি ত্রিপুরায় ভারি বর্ষণ বন্ধ না হয়, তাহলে ফের মৌলভীবাজারের দেখা দিতে পারে বন্যা।
শেরপুর: দুই দিনের টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি নদী ভোগাইয়ের অন্তত ১৩টি স্থানে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। নদীর তীর গড়িয়ে প্লাবিত হচ্ছে চেল্লাখালী নদীর পানিও। এতে পৌরসভাসহ এ উপজেলার অন্তত অর্ধশত গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। শনিবার ভোর থেকে দেখা গেছে, পাহাড়ি নদী চেল্লাখালীর তীর উপচে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে ঢলের পানি আশপাশের গ্রামে প্রবেশ করছে। এতে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে এবং পুকুরের মাছ ভেসে গেছে বানের পানিতে।
বান্দরবান: বান্দরবানে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনার পর থেকে বৃষ্টি এলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে স্থানীয়রা। টানা বৃষ্টির কারণে বান্দরবানের সঙ্গে রুমাসহ বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
হবিগঞ্জ: হবিগঞ্জে অব্যাহত বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ২০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়তে থাকায় শহরের লোকজনের মধ্যে আবারও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার সবকটি নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শনিবার সকালে নেত্রকোনার সুমেশ্বরী নদীর পানি বিরিশিরি পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪০ সেন্টিমিটার, কংস নদীর পানি জারিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার, উবধাখালি নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন জেলায় টানা বৃষ্টিতে নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন