সাধারণভাবে একজন চাকরিজীবীর কথা যদি আমরা হিসাব করি তাহলে দেখা যায়, সারা মাস মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রমের পর তিনি যখন বেতন পান তখন তার বেতনের নির্ধারিত অংশ ট্যাক্স বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা হয়। ঠিক একইভাবে একজন ব্যবসায়ীর কথা যদি চিন্তা করা হয় তাহলেও একই অবস্থা দেখা যাবে। এভাবেই সকল পেশার মানুষ সর্বোপরি দেশের সাধারণ জনগণের পরিশ্রমের টাকায় ভ্যাট-ট্যাক্সে ভারী করে তোলা হয় সরকারি কোষাগার। উদ্দেশ্য দেশ পরিচালনা এবং উন্নয়নের প্রয়োজনে যাতে চাহিদামত যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা যায়।
জনগণের রক্ত পানি করা এ টাকার হরিলুটের খবর নতুন কিছু নয়। সর্বশেষ আমরা দেখেছি সরকারি খরচে হজের নামে ৩১৮ জনকে সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের পেছেনে গড়ে কমপক্ষে ৪ লাখ টাকা করে খরচ হবে। সেই হিসাবে ৩১৮ জনের পেছনে রাষ্ট্রের খরচ হবে প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
হজকে ইসলাম ধর্মে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসলাম ধর্মমতে, সংসার পরিচালনার যাবতীয় খরচ পরিচালনার পর যদি কোন ব্যক্তি মক্কা-মদিনায় আসা যাওয়া এবং সেখানে ভ্রমণের পর যদি সংসার পরিচালনায় আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হন এবং শারীরিকভাবে সক্ষম থাকেন তবে সেই ব্যক্তির উপর হজ পালন করা অবশ্য কর্তব্য। সেই হিসেবে ধার-দেনা করেও হজে যাওয়ার বিষয় ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না।
এখন প্রশ্ন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারি খরচে যারা এবার কিংবা বিগত বছরগুলোতে হজে গিয়েছেন তারা কি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নন? এবারের যারা হজে যাওয়ার তালিকায় আছেন তাদের কথাই ধরা যাক। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শরাফত জামান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে এবারের তালিকায় বেশ কয়েকজন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য রয়েছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে ঢাকা-১৫ আসনের সংসদ সদস্য, সংরক্ষিত আসন-৯ চুয়াডাঙ্গা, সংরক্ষিত আসন-২ কুড়িগ্রাম- লালমনিরহাট, সংরক্ষিত আসন-১৯ ময়মনসিংহের সংসদ সদস্য এ বছর হজে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে একজন আবার ২০১৫ সালেও একবার সরকারি খরচে হজে গিয়েছিলেন।
এ তালিকায় আরও আছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা), ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক, স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব। এছাড়া ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সংসদ সদস্য ও উত্তরখান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকাসহ এমন আরও অনেকে রয়েছেন। সরকারি খরচে অস্বচ্ছল ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’দের হজ করানোর কথা থাকলেও দেখা যায় এখানে যারা আছেন তাদের বেশিরভাগ হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং দলীয় নেতাকর্মী।
উপরের তালিকায় যেসব নাম দেখা গেছে তাদের একজনও কি নিজের সংসার পরিচালনায় অস্বচ্ছল? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এসব এমপি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি কিংবা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা কেউ কি আছেন যারা সৌদি আরবে গিয়ে হজ করে আসার পর নিজের সংসার পরিচালনায় ব্যর্থ হবেন? তর্কের খাতিরে যদি ধরাও হয় যে, তারা অস্বচ্ছল তাহলে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় খরচে হজ করানোর দরকার কি? কেন এখানে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হয়ে জনগণের ট্যাক্সের টাকা ঢালতে হবে?
আরো আলোচনার আগে চলুন ইতিহাসের একটি ঘটনা জেনে আসি। হযরত ওমর (রা.) তখন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। এক রাতে তার বন্ধু দেখা করতে এলে তিনি নিজের কক্ষের আলো নিভিয়ে ওই বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুরু করেন। তার বন্ধু অবাক এবং একপর্যায়ে অপমান বোধ করে ওমরকে জিজ্ঞেস করেন, আমি আসার সঙ্গে সঙ্গে তুমি রুমের আলো নিভিয়ে দিলে কেন? আমি আসায় কী তুমি বিরক্ত? এই প্রশ্নের জবাবে ওমর (রা.) বললেন- না, তুমি আসায় আমি বিরক্ত নই বরং আনন্দিত। আমি এতক্ষণ রাষ্ট্রের দেয়া টাকায় আলো জালিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজ করছিলাম। কিন্তু তুমি আসার পর তো আমি আর রাষ্ট্রীয় কাজ করছি না। এখন আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ব্যক্তিগত। তাই রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে আলো জ্বালিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করার অধিকার আমার নেই।
তেমনিভাবে আমাদের রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তারাও জনগণের টাকা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো খরচ করতে পারেন না। সেটা ইসলাম যেমন সমর্থন করে না তেমনি সাধারণ রাষ্ট্রীয় আচারও সমর্থন করতে পারে না।
ফ্রান্স-মাক্রোঁ-ফার্স্ট লেডিচলুন, সাম্প্রতিক সময়ের ফ্রান্সের একটি ঘটনার দিকে নজর দেই। ফ্রান্সে ফার্স্ট লেডির অফিসিয়াল কোন পদ নাই। তার মানে ফ্রান্সের মানুষ রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে দেশের জন্য কাজ করা স্বয়ং প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর পেছনে রাষ্ট্রীয় টাকা তেমন একটা খরচ করতে আগ্রহী নয়। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল মাক্রোঁ চেয়েছিলেন তার স্ত্রীর জন্য এই পদটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে দেবেন। তার এমন মনোভাব আঁচ করতে পেরেই এর বিরুদ্ধে একটি অনলাইন পিটিশন দায়ের করেন বেশ কয়েক লাখ মানুষ। আর এ কারণেই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেন প্রেসিন্টে ইম্যানুয়েল মাক্রোঁ। এটা হচ্ছে জনগণের জন্য রাজনীতি। জনগণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার সংস্কৃতি।
কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভিন্ন। এখানে জনগণের টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ না করে জনগণের উপর ট্যাক্স বাড়ানোর ফন্দি করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি সম্প্রতি রাজধানীতে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর বিষয়ে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে গত ১০ আগস্ট রাজশাহীতে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘বিশাল বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাজস্ব বাড়াতে হলে রাজধানীসহ বড় বড় শহরগুলো থেকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে।’একইভাবে ব্যাংকে জমানো সাধারণ মানুষের সঞ্চয় থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল খাত থেকে ট্যাক্স বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
কিন্তু এসব টাকা জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যবহার না করে ‘সরকারি মাল দরিয়ায় ঢাল’ নীতিতে খরচ করা হচ্ছে! জনগণের টাকা এভাবে হরিলুটের জন্য আর কোন কোন খাতে কত টাকা ট্যাক্স বাড়ানোর প্রয়োজন তা কি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জানাবেন?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন