‘বাপ-দাদার জন্মে এমন বান দেখি নাই বাহে। মুই মরা মানুষটা বাচি উঠছং। ১৮ ঘন্টা পানির উপর ভাসি আছলং। সরইলত কোন বল আছিল না। বাঁচার আশাও আছিল না।’
‘খালি আল্লাহ-আল্লাহ ডাকতে ডাকতে চোখ বন্ধ হয়া যায়। হঠাৎ ডাকাডাকি করলে হুস হয়। দেখং নাতি নৌকা নিয়া দাড়ায়। ফ্যাস ফ্যাস গলায় কনু, মুই মরি গেছনু, এ্যালা দ্যাখং বাঁচি আছং। রাখে আল্লাহ মারে কে?’
বৃহস্পতিবার বিকালে ভাঙা-ভাঙা গলায় এ কথাগুলো বলেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের নদী বিচ্ছিন্ন সারডোব গ্রামের সদর আলী (৮৬)।
সদর আলী জানান, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের নদী বিচ্ছিন্ন সারডোব গ্রামের বাঁধের পারের অধিবাসী তিনি। কৃষিকাজ করে চলে সংসার। ৫ ছেলে এক মেয়ে সবাই বিয়ের পর আলাদা সংসার গড়ে। তাই বৃদ্ধা আয়ন বিবিকে নিয়ে সদরের ছোট সংসার।
শনিবার বিকালে ঘরেই ছিলেন সদর আলী। হঠাৎ পানির গর্জন শুনে আতংকিত হয়ে পড়ে। তিনবার নদীভাঙা পোড় খাওয়া এ মানুষটি আগে কখনও এতো ভয় পাননি। শো-শো শব্দ তার হৃদয়ে আঘাত করতে থাকে। বুড়িকে নিয়ে সে বাঁধে আশ্রয় নেন। এসময়েই হাটুপানি এসে যায়।
সদরের মন আনচান করতে থাকে বাড়ি থেকে কিছুই নেয়া হলো না।
একমাত্র সম্বল হালের দুটি বলদ রক্ষার চিন্তা মাথায় ঢুকে যায়। উঁচু একটা ভাল জায়গা দেখে গরু দুটি আনার জন্য মনস্থির করেন সদর আলী। সবাই বাধা দেয়। জীবনে ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে ফেরা ঠিক হবে না। কিন্তু স্ত্রীসহ সবার বাধা উপেক্ষা করে গরুর জীবন বাঁচাতে বাড়িতে ফেরেন।
তখন বিকাল ৪টা হবে। আসর নামাজের আযান তখনও হয়নি। বাড়ির কাছাকাছি যেতে না যেতেই স্রোতের টানে ভেসে যান সদর আলী। কিছুদুর পথ যাওয়ার পর আকড়ে ধরে একটি পাটের জাগ। সে পাটের জাগও দ্রুত গতিতে নদীর দিকে ছুটছিল। এরপর একটি গাছ আঁকড়ে ধরার চেষ্টাও বিফলে যায়। সর্বশেষ হেলেপড়া একটি খড়ের গাদা আঁকড়ে ধরে। অনেকবার পানিতে হাবুডুবু খেয়ে পেট ভরে যায় বানের পানিতে।
একপর্যায়ে উঠে পড়ে খড়ের গাদার উপর। এরপর চিৎকার করতে থাকে সাহায্যের জন্য। নির্জন জনমানব শূন্য এখানে সে একা। তাই কেউ সাড়া দেয় না সদর আলীর ডাকে। গলা ভেঙে যায়। গলার আওয়াজ আর বের হয় না। খাওয়া নেই। চারদিকে অন্ধকার।
আতংক গ্রাস করে তাকে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বাঁচার সব আশা ছেড়ে দিয়ে গুনতে থাকে মৃত্যুর প্রহর। শুধু ডাকতে থাকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতালাকে।
তারপর আর কিছু বলতে পারের না সদর আলী।
পরদিন রোববার সকাল ১০টার দিকে অনেক মানুষের হৈ চৈ আর ডাকাডাকির শব্দে শরীরে অনুভূতি ফিরে আসে। চোখ খুলে স্বজনসহ অনেক মানুষ দেখে নিজের বেঁচে থাকার বিশ্বাস ফিরে আসে এই বৃদ্ধের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন