আবদুল মতলব। শরণার্থী হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে এসেছেন ১৪ বছর আগে, ২০০৩ সালে। তখন তার বয়স ছিল ৫৩ বছর। পেছনে রেখে এসেছিলেন চার ছেলে ও স্ত্রীকে। এতকাল তার ছেলেদের একজন ছাড়া বাকিরা মিয়ানমারেই ছিলেন। বড় ছেলে আয়াজ করনি ২০১২ সালের সহিংসতার সময় সাগরপাড়ি দিয়ে চলে যান মালয়েশিয়ায়। গত ২৪ আগস্টের পর মিয়ানমারে সেনা অভিযান শুরু হলে পরিবারের বাকি সদস্যরা সেখানে টিকে থাকতে না পেরে চলে এসেছেন বাংলাদেশে।
সম্পন্ন কৃষক পরিবারের ছেলে মতলব পড়াশোনা করেছিলেন মংডু ও বুচিডংয়ে। তবে পড়াশোনা শেষে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। মংডু টাউনশিপ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম উদংয়ে ফিরে আয় রোজগারের জন্য করেন চিড়িংঘের। পৈতৃক কৃষিকাজ তো ছিলই। এই সবের ফাঁকে জড়িয়ে পড়েন অং সান সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সঙ্গে। তখনও ১৯৮২ সালের বিতর্কিত বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইন হয়নি, যে আইনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। মতলবের স্বপ্ন ছিল পশ্চাৎপদ রোহিঙ্গাসমাজের এগিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রাখবেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন রাজনীতিমনস্ক।
তার শিক্ষক ওজিউল্লাহ ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে চলে আসেন এবং এরপর আর কোনোদিনই ফিরে যাননি মিয়ানমারে। ওজিউল্লাহ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভক্ত। তাদের শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলতেন। পাকিস্তানি সামরিকজান্তার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যখন শেখ মুজিব আন্দোলন করছেন, তখন ওজিউল্লাহ আক্ষেপ করতেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে এমন একজন নেতা নেই বলে। পরে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার নিগড় থেকে যখন পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করে মুজিব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন, ওজিউল্লাহ তখনই বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর আর প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না। একবার খবর পেয়েছিলেন শিক্ষক মারা গেছেন, তবে ঢাকায় না চট্টগ্রামে তার মৃত্যু হয়েছে সেটা মতলব মনে করতে পারেন না। সেই থেকে মতলব নিজেও শেখ মুজিবের ভক্ত হয়ে উঠেছেন।
বহুদিন পর ওজিউল্লাহর কথা আবদুল মতলবের মনে পড়ল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সহমর্মিতা জানাতে আসার পর। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী এই মানুষটি যদিও স্বপ্ন দেখেন নিজ দেশে ফিরে যাবেন,সেখানেই রোহিঙ্গারা তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে প্রতিষ্ঠা পাবে,তবু বাংলাদেশে বাস করেন বলে,এখানে আশ্রয় পেয়েছেন বলে কৃতজ্ঞ বোধ করেন। খোঁজখবর রাখেন বাংলাদেশের রাজনীতির। বললেন,শেখ হাসিনা সরকারে থাকলেও পাশে আছেন,না থাকলেও থাকেন। বিরোধী দলে থাকাকালে তিনি এসেছেন রোহিঙ্গাদের দেখতে।
২০০১ সালে আকিয়াবে রাখাইনদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাতের ঘটনায় জেলে যেতে হয় মতলবকে। মিয়ানমারে তখন সামরিক শাসন চলছে। সুচি অন্তরীণ। ২০০৩ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মতলব চলে আসেন বাংলাদেশে। তখন তার ছোট ছেলে মোহম্মদ জাবেরের বয়স ছিল সাত বছর।
মতলবের স্ত্রী উম্মে সেলিমা স্বামীর রেখে আসা সম্পত্তির ওপর নির্ভর করে সংসার পরিচালনা শুরু করেছিলেন। তবে চলার পথটা যে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না,সেটা এবার মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা এই মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারা গেছে। মতলব যে চিড়িংঘের করেছিলেন সেটা বেদখল হয়ে যায়, তিনি দেশ ছেড়ে আসার পরপরই। জমিজমাও রক্ষা করতে পারেননি। সব ফেলে এবার চলে এসেছেন বাংলাদেশে, সামনে তাদের শরণার্থী জীবন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন