গত ৪ মে ভিজিটিং কার্ড আনতে শ্যালক সায়েম বিল্লাহসহ মতিঝিলের আরামবাগে গিয়েছিল র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি কমান্ডার ইমাম মেহেদী হাসান ওরফে জিব্রিল। বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই তাদের দু’জনের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর থেকে তারা নিখোঁজ ছিল। এ ব্যাপারে খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন মেহেদীর বড় ভাই ওয়ালিউল আলম।
এদিকে বৃহস্পতিবার কাওরান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে র্যাব দাবি করে, গত বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী এলাকা থেকে তাকে (মেহেদী) গ্রেফতার করা হয়। সে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন (জেএমবি) ‘সারোয়ার-তামিম গ্রুপ’ এর ‘ব্রিগেড আদ্-দার-ই-কুতনী’র কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। সে ঢাকার দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পড়াশোনা শেষ করেছে। ছাত্রাবস্থায় সে র্যাম্প মডেলিংয়েরও কাজ করেছে। তার বাড়ি পটুয়াখালী জেলার বাউফলের রাজাপুরে। তবে তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করে বলে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে।
র্যাবের দেওয়া তথ্য মতে, জেএমবি (সারোয়ার-তামিম গ্রুপ) দু’টি অপারেশনাল ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করে তাদের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এর মধ্যে ‘বদর স্কোয়াড ব্রিগেড’ হলি আর্টিজানসহ অন্যান্য হামলায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে। আর ‘ব্রিগেড আদ্-দার-ই-কুতনী’ ব্যাকআপ বা রিজার্ভ ব্রিগেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এই ‘ব্রিগেড আদ্-দার-ই-কুতনী’ তথ্য প্রযুক্তিতে অত্যাধুনিক। এবং এ ব্রিগেড গোপনে সদস্য সংগ্রহে নিয়োজিত ছিল। সারাদেশে জঙ্গিবিরোধী ব্যাপক অভিযানে মূল অপারেশনাল কাজে অংশগ্রহণকারী ‘বদর স্কোয়াড ব্রিগেড’ এর বেশিরভাগ সদস্য নিহত ও আটক হওয়ায় ব্রিগেডটি দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ব্যাকআপ ব্রিগেড হিসেবে থাকা ‘ব্রিগেড আদ্-দার-ই-কুতনী’ নতুন করে সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে দুর্বল হয়ে পড়া ব্রিগেডকে শক্তিশালী করতে কার্যক্রম শুরু করে।
র্যাব ৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, ‘মেহেদী ২০১৫ সাল হতে জেএমবি’র সারোয়ার-তামিম গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। হলি আর্টিজান ও কল্যাণপুরের আস্তানায় নিহত জঙ্গিদের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। শুরুতে সে সদস্য সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণ ও হিজরতের পূর্ব প্রস্তুতিমূলক পর্বগুলো সম্পন্ন করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। পরবর্তীতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে জঙ্গিরা কোণঠাসা হয়ে পড়লে, সে জেএমবি’র সারোয়ার- তামিম গ্রুপের রিজার্ভ হিসেবে থাকা ‘ব্রিগেড আদ দার-ই-কুতনী’র কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং কর্মী সংগ্রহে নিয়োজিত হয়।’
মেহেদীর সংগ্রহে থাকা সদস্যদের একটা অংশের আনুগত্য পরীক্ষা করার জন্য বাইয়্যাত (শপথ) পড়িয়ে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ছিল বলে জানান এই র্যাব কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘ইমাম মেহেদী হাসান ওরফে আবু জিব্রিল ঢাকা, টাঙ্গাইল ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলায় উদ্বুদ্ধ সদস্যদের মাঝে শপথ (বাইয়্যাত) প্রদান করে। উক্ত শপথ (বাইয়্যাত) এর ভিডিও চিত্র ধারণ করে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে উগ্রবাদী চ্যানেলে প্রচারের মাধ্যমে সে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতো।’
মেহেদীর নেতৃত্বে থাকা ‘ব্রিগেড আদ্-দার-ই-কুতনী’র সদস্যদের যেকোনও ধরনের নাশকতা পরিচালনার সামর্থ্য রয়েছে বলে মন্তব্য করেন লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ। তিনি বলেন, ‘তার কাছ থেকে দু’টি ল্যাপটপ, একটি মোবাইল, একটি পাসপোর্ট, উগ্রবাদী বইসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। তার ল্যাপটপে অনেক তথ্য রয়েছে। তথ্যগুলো যাচাই করে এবং মেহেদীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ব্রিগেড ‘আদ্-দার-ই-কুতনী’ অপারেশনাল সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং যেকোনও স্থানে নাশকতা চালাতে সক্ষম। এই ব্রিগেডের বাকি সদস্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ’
র্যাব জানিয়েছে, ইমাম মেহেদী হাসান বনানী থানার সন্ত্রাস দমন আইনের একটি মামলায় এজাহার নামীয় আসামি ও উত্তরা পশ্চিম থানার সন্ত্রাস দমনে আইনে দায়ের করা আরেকটি মামলার তদন্তে প্রাপ্ত আসামি। এছাড়াও তার নামে আরও মামলা রয়েছে।
‘ব্রিগেড আদ্-দার-ই-কুতনী’র চারটি ভাগ রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। এর মধ্যে রয়েছে আনসার (সাহায্যকারী), মুহাজির (যোদ্ধা), সালাফি আলেম বোর্ড ও অর্থ প্রদানকারী। গ্রেফতার মেহেদীর সঙ্গে জঙ্গিবাদের অর্থায়ন করে এমন প্রবাসী বাংলাদেশিদের যোগাযোগ বেশ ভালো। এছাড়াও তার সঙ্গে সারোয়ার-তামিম গ্রুপের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সদস্য পর্যন্ত তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল।
মেহেদীর বরাত দিয়ে র্যাব ৩ -এর সিও লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, ‘ব্রিগেড আদ্-দার-ই-কুতনী’কে শক্তিশালী করতে মেহেদীর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ সদস্যরা নিয়মিতভাবে তাকে ইয়ানত (অর্থ) প্রদান করতো। যা পরবর্তীতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশে জঙ্গি কার্যক্রমে ব্যয় হতো। এছাড়াও মেহেদী জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ সদস্যদের মধ্যে সাংগঠনিক বিয়ের ব্যবস্থা দেখভাল করতো। তার মাধ্যমে হিজরত করা দুই জঙ্গি ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে।’
এদিকে বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী এলাকা থেকে ইমাম মেহেদী হাসানকে র্যাব গ্রেফতার করলেও তার পরিবারের দাবি, গত ৪ মে থেকে সে (মেহেদী ) তার শ্যালকসহ নিখোঁজ ছিল। নিখোঁজের ঘটনায় খিলগাঁওয়ে একটি সাধারণ ডায়েরিও করা হয়।
নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে মেহেদীর বড় ভাই ওয়ালিউল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেহেদী ৪ মে বাসা থেকে মতিঝিলের আরামবাগের উদ্দেশে বের হয়। ভিজিটিং কার্ডসহ আরও কিছু জিনিস আনতে সে তার শ্যালক সায়েম বিল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে যায়। বাসা থেকে যাওয়ার পর তাদের দু’জনের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাই। কোথাও কোনও খোঁজ না পেয়ে আমরা খিলগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি করি এবং র্যাবকেও জানাই। কিন্তু তারা কোনও খোঁজ দিতে পারে নি।’
মেহেদী প্রায় তিন বছর ধরে নিয়মিত নামাজ পড়তো বলে জানান ওয়ালিউল। কিন্তু সে যে জঙ্গিবাদের জড়িয়ে পড়বে তা কখনও ভাবতে পারেননি ওয়ালিউল আলম। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা করার সময় সে র্যাম্প মডেলিংয়ের কাজ করতো। কিন্তু পরিবার থেকে এ ব্যাপারে খুব একটা সমর্থন পায়নি। বছর তিনেক আগে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করে। দাড়ি রাখে। তার পোশাকেও পরিবর্তন আসে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেও বাড়ির বাইরে রাত কাটানো বা তাবলিগে যাওয়ার বিষয়ে পরিবার থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সে এ পর্যন্ত একদিন করে সর্বোচ্চ তিনদিন বাসার বাইরে ছিল। এছাড়া সে বাইরে থাকেনি।’
মেহেদীর শ্যালক সম্পর্কে ওয়ালিউল আলম বলেন, ‘তার শ্যালক সায়েম বিল্লাহ সদ্য এসএসসি পাস করেছে। তার বাবা ব্র্যাকের কর্মকর্তা। মেহেদীর পায়ে ব্যথা থাকায় ওইদিন সায়েমকে সঙ্গে নিয়ে মতিঝিল গিয়েছিল। কিন্তু তারা বাসা থেকে যাওয়ার পর দু’জনের মোবাইল নম্বরই একসঙ্গে বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর তাদের আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।’
শ্যালকসহ মেহেদীর নিখোঁজ থাকার বিষয়ে থানায় দায়ের করা সাধারণ ডায়েরির বিষয়ে জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘মেহেদীকে র্যাব গ্রেফতার করেছে। আমাদেরকে এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। আর ৪ মে সাধারণ ডায়েরি হয়েছে কিনা আমি জানি না। আমি নতুন এসেছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন