শনিবার দুপুর পৌনে একটা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বহিঃবিভাগের চক্ষু ইউনিট থেকে দুই কারারক্ষির কাঁধে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নামছিলেন কালো চশমা পরা দৃষ্টিহীন এক যুবক। পুলিশ হেফাজত থেকে পালানোর সম্ভাবনা না থাকলেও তার হাতে ছিলো হ্যান্ডকাফ, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি!
কাছে গিয়ে জানা গেল, নাম তার শাহজালাল ওরফে শাহজামাল (৩০)। খুলনার খালিশপুর থানার একটি ছিনতাইয়ের মামলার এই আসামিকে গতকাল কারাগার থেকে হাতকড়া-ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে এনে চিকিৎসা দেয়া হয় ঢামেক হাসপাতালে। কিছুদিন আগেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহজালাল ছিলেন সুস্থ-সবল মানুষ। মর্মান্তিক একটি ঘটনায় তিনি চিরতরে অন্ধ হয়ে যান।
শাহজালাল ও তার স্বজনদের দাবি, গত ১৮ জুলাই রাতে ১০ মাসের শিশু কন্যা আঁখির জন্য দুধ কিনতে বের হন শাজালাল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে আটক করে নিয়ে যায় খুলনার খালিশপুর থানার পুলিশ। ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে তারা দেড় লাখ টাকা দাবি করে। কিন্তু উৎকোচের টাকা না পেয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে নির্মমভাবে তার দু’চোখ তুলে নেন পুলিশ সদস্যরা। অথচ পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে শাহজালালের চোখ সম্পূর্ণ ভালো ছিলো। থানার সিসি টিভি ক্যামেরা যাচাই-বাছাই করলেই এর তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে আসবে।
তবে অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে ওই থানা পুলিশের ভাষ্য, খালিশপুরের গোয়ালখালী মোড়ে ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর শাহজালালের দুচোখ উৎপাটন করে স্থানীয়রা। এই বিষয়ে ৩০ জুলাই আদালতে শাহজালালের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়েছে। যদিও শাহজালালের চোখ তুলে নেওয়া সেই ‘স্থানীয়’ কাউকেই আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ।
শালজালালের চোখ উৎপাটনের ঘটনায় থানায় ও আদালতে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। খুলনার খালিশপুর থানায় শাহজালালের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন শাহজালাল কর্তৃক ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করা তরুণী সুমা আক্তার। আর শাহজালালের চোখ তুলে নেওয়ার অভিযোগ এনে খালিশপুর থানার ওসিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে খুলনা মহানগর আদালতে অন্য মামলাটি করেন শাহজালালের মা মোছা. রেনু বেগম।
এই মামলার আসামিরা হলেন- খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খান, এসআই রাসেল, এসআই তাপস রায়, এসআই মোরসেলিম মোল্লা, এসআই মিজান, এসআই মামুন, এসআই নূর ইসলাম ও এএসআই সৈয়দ সাহেব আলী এবং আনসার সদস্য (সিপাই) আফসার আলী, আনসার-ল্যান্স নায়েক আবুল হোসেন, আনসার নায়েক রেজাউল। অপর দু’জন হলেন- পুরান যশোর রোড এলাকার বাসিন্দা সুমা আক্তার ও শিরোমনি বাদামতলা এলাকার রাসেল। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আগামী ১৮ অক্টোবর মামলার পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, দৃষ্টিহীন একজন মানুষকে এভাবে হাতকড়া-ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে চিকিৎসা দেয়া যায় কি না? যদিও এ ধরনের আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে এভাবে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়াকে অমানবিক এবং আইন ও বিধি লঙ্ঘন বলছেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
গতকাল দুপুরে ঢামেক হাসপাতালে শাহজালালের বাবা জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। স্বজন ও শাহজালালের বরাত দিয়ে তিনি আমাদের সময়কে জানান, তার ছেলে কাঁচামালের ব্যবসা করতো। গত ১৬ জুলাই স্ত্রী রাহেলাকে আনতে গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সুবিদপুর থেকে শ্বশুরবাড়ি যান শাহজালাল। ১৮ জুলাই বিকাল সাড়ে চারটার দিকে তার ১০ মাসের মেয়ের খাবারের গুঁড়ো দুধ আনতে বাসা থেকে গোয়ালখালী মোড়ের উদ্দেশ্যে বের হয়। রাত ৯টার দিকে স্থানীয় নয়নসহ ৩জন যুবক বাসায় এসে জানায়, পুলিশ ছিনতাইয়ের অভিযোগে শাহজালালকে গোয়ালখালী বাসস্ট্যান্ডের কাছ থেকে ধরে নিয়ে গেছে। এরপর শাহজালালের স্ত্রী রাহেলাসহ স্বজনরা রাত সাড়ে ৯টার দিকে খালিশপুর থানায় গিয়ে শাহজালালকে পান। তার সঙ্গে কথাও হয় তাদের। শাহজালাল বলেছে, বিনা কারণে দারোগা তাপোস ও রাসেল ধরেছে। তার মানিব্যাগে থাকা ৯শ টাকা ও একটি সিমফোনি মোবাইলও হাতিয়ে নেয় তারা। তখনও শাহজালালের চোখ ভালো ছিল। এক পর্যায়ে তাদের দেখে একজন বলেন, দেড় লাখ টাকা দিলে শাহজালালকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। দেনদরবারের পর ২০ হাজার টাকা দেয়ার কথা বললে ওই টাকায় কাজ হবে না বলে পুলিশ তাদের সাফ জানিয়ে দেয়।
তিনি আরও জানান, রাত সাড়ে ১১টার দিকে একটি গাড়িতে করে পুলিশ যখন শাহজালালকে থানার বাইরে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন স্বজনরা তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানতে চায়। এসময় পুলিশ বলে, চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে। শাহজালালদের গাড়িতে ৪-৫জন পুলিশ ও দুটি মোটরসাইকেলে আরও চারজন পুলিশ ছিল সেসময়। ২টা পর্যন্ত থানায় বসে থাকলেও শাহজালালের দেখা পায়নি স্বজনরা। একপর্যায়ে শাহজালালকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয় থানা পুলিশ। কিন্তু শাহজালাল না ফেরায় ভোররাতের দিকে থানায় গেলে স্বজনদের বলা হয়, খুলনা মেডিক্যাল কলেজে (২৫০-বেড) চিকিৎসাধীন শাহজালাল। সেখানে গিয়ে তারা হাসপাতালের বারান্দায় শাহজালালকে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখেন। এসময় তার চোখ ছিলো সাদা কাপড় দিয়ে বাধা। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল পুরো শরীর।
ঘটনার বর্ণনায় শাহজালালের বরাত দিয়ে জাকির হোসেন জানান, দাবিকৃত দেড় লাখ টাকা না পেয়ে মধ্যরাতে পুলিশ সদস্যরা শাহজালালকে খালিশপুর ক্লিনিকের পাশেই একটি ওষুধের দোকানে নিয়ে তার হাত ব্যান্ডেজ করে। এরপর তারা শাহজালালকে গোয়ালখালী হয়ে বিশ্ব রোডের (খুলনা বাইপাস সড়ক) একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে যখন তাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়, তখন শাহজালাল ভেবেছিলো তাকে ক্রসফায়ার দেয়া হবে। একপর্যায়ে শাহজালালের হাত-পা চেপে ধরে ও মুখে গামছা ঢুকিয়ে স্কু ড্রাইভার দিয়ে তার দুই চোখ উপড়ে ফেলে দুজন পুলিশ। তাদের সহযোগিতা করেন অন্য অভিযুক্তরা। এরপর মিথ্যা একটি মামলায় শাহজালালকে আসামি করে রাত ৩টার দিকে তাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেখে আসেন পুলিশ সদস্যরা।
জাকির হোসেন বলেন, চোখ নষ্ট হওয়ার এক দিন আগেও মেয়ে আঁখিকে দেখে শাহজালাল বলেছিল, ‘কবে আমি ওর হাঁটা দেখব। মেয়েটা কবে হাঁটতে পারবে?’ গত সপ্তাহে আঁখি প্রথম হেঁটেছে। কিন্তু তা দেখতে পেল না ছেলেটা বলে কান্না জুড়ে দেন অসহায় এই বাবা। ছেলের দুই চোখ উপড়ে ফেলার ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
শাহজালালের মায়ের করা মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. মোমিনুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, একজন দুর্ধর্ষ অপরাধীর ক্ষেত্রে ডাণ্ডাবেড়ি ব্যবহার করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু দৃষ্টিহীন একজনকে এভাবে হাতকড়া-ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে চিকিৎসা দেওয়া সুনির্দিষ্ট আইনের লঙ্ঘন এবং অমানবিক। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করায় ক্ষোভের বহি:প্রকাশের অংশবিশেষ হিসেবে এটাকে দেখছি আমরা।
তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহজালালকে ছিনতাইকারী সাজিয়ে পরিকল্পিতভাবে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এ পরিণতিতে মানবেতর জীবন যাপন করছে তার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা। আদালতের নির্দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে শাহজালালের চোখ উৎপাটনের মামলাটি বর্তমানে পিবিআই তদন্ত করছে। নথিপত্র এখনও নাকি তারা পাননি। তাদের তদন্তে পাওয়া তথ্য এবং বাদির তথ্য-প্রমাণ যথাসময়ে আদালতে হাজির করা হবে বলেও জানান তিনি।
পুলিশের বিরুদ্ধে শাহজালালের চোখ উপড়ে ফেলার অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খান জানান, ১৮ জুলাই রাত পৌনে ১২টার দিকে খালিশপুর গোয়ালখালী বাসস্ট্যান্ডে মোটরসাইকেলে ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় জনতা শাহজালালকে আটক করে গণধোলাই দেয়। পরে তার চোখ তুলে নেয় তারা। খবর পেয়ে পুলিশই তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। যেখানে পুলিশ তার জীবন বাঁচালো সেখানে গুরুতর এমন অভিযোগ তোলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও দাবি করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন