আইন একটি চলমান ‘প্রাণী’। সে গতিশীল। সে যে গতি মেনে চলে, তার নাম ‘নিজস্ব গতি’। ধীরগতি, দ্রুতগতি—এসবের সে ধার ধারে না। সে কখনো অ-গতির গতি; কখনো দুর্গতি হয়ে দেখা দেয়।
আইন চলতে পারে; কিন্তু দেখতে পায় না। সে অন্ধ। অন্ধ বলেই সে কাউকে ছাড় দেয় না। সে সাম্যবাদী। তার ‘চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই’। তার কাছে সবাই সমান। ধনী-গরিব; উঁচু-নিচু; আশরাফ-আতরাফ; রাজা-প্রজা; ছাত্রদল-ছাত্রলীগ—সব সমান। আইনের চোখে কেউ কেউ একটু বেশি সমান।
এই যেমন ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকির। তিনি আইনের ‘গতিতত্ত্ব’ ব্যবহার করে যে মারাত্মক কেরামতি দেখিয়েছেন, তা দেখে খোদ আইনজ্ঞরা হেঁচকি তুলতে শুরু করেছেন।
আইনের ‘দেহে’ একটাই খুঁত। সেটা হলো ‘ফাঁক’। এই ফাঁক খুব খারাপ জিনিস। কাদার মধ্যে ছোট ছোট ক্যাড়া বাইন মাছ যেমন গেরিলাযোদ্ধার মতো ক্রলিং করতে করতে হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়, সেই কায়দায় আইনের ফাঁক দিয়েও বহু ইবলিস বেরিয়ে যায়। আবার ফাটা বাঁশে আটকা পড়ার মতো অনেক ভালো মানুষও আইনের এই ফাঁকে আটকে পড়ে। অনেকের জীবন হারিয়ে যায় ফাঁকের ফোকরে পড়ে।
নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে একটি আমেরিকান ক্রাইম সিরিয়াল হতো। নাম ‘ডার্ক জাস্টিস’। সেখানে নিকোলাস মার্শাল নামের একজন বিচারক ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাঁর আদালত থেকে অপরাধীরা আইনের মারপ্যাঁচে দিয়ে ছাড়া পেত। নিকোলাস রায়ের কাগজে ঠাস করে সিল মেরে বলতেন, ‘কেস ডিসমিস’। মামলা খারিজের আনন্দে আসামিদের মুখ ঝলমল করে উঠত। তারা যখন এজলাস ছাড়ত, তখন নিকোলাস তাদের ডেকে বলতেন, ‘আইন অন্ধ হলেও অন্ধকারেও তা দেখতে পায়।’ এরপর সেই বিচারক ছদ্মবেশে নানা অ্যাডভেঞ্চারের মধ্য দিয়ে ছাড়া পাওয়া আসামিকে আবার আইনের কবজায় আটকাতেন। প্রায় প্রতিটি পর্বে আইনের জয় হতো। পর্বগুলো শেষ হতো সেই বিখ্যাত সংলাপে, ‘আইন অন্ধ হলেও অন্ধকারেও তা দেখতে পায়।’
আমাদের দেশে অন্ধ আইন ‘নিজস্ব গতিতে’ চলে এবং আইনের ‘ফাঁক’ আছে—এই সুমহান পাঠ; এই জীবনমুখী শিক্ষা আমরা প্রতিনিয়তই পাই। এই শিক্ষায় আমরা বেশ শিক্ষিত হয়ে উঠেছি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সমস্ত ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকেরা হাতে এবং কলমে—দুই মাধ্যমেই ভারি মিষ্টি করে আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে এসেছেন।
সর্বশেষ আসলাম ফকির আমাদের চোখের মধ্যে মরিচমাখা আঙুল ঢুকিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আইনের ‘ফাঁক’ এবং ‘নিজস্ব গতি’ কী জিনিস। তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ আলী ওরফে সাহেব আলী মিয়াকে ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর টুক করে খুন করে বসেন। এই ইউপিতে তিনি এবং সাহেব আলী পর্যায়ক্রমে চেয়ারম্যান হচ্ছিলেন। এক বনে দুই বাঘ থাকা ভালো কথা না। আসলাম ফকির তাই প্রতিপক্ষের বাঘটাকে এক থাবায় সাবাড় করে দিয়েছিলেন।
জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসলামকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। হাইকোর্ট এই রায় বহাল রাখেন। ২০১৩ সালের ১৯ মে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান আসলাম। তা নামঞ্জুর হয় এবং ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ফাঁসির দিন ঠিক হয়। এইবার আসলাম ফকির তাঁর কেরামতি দেখানো শুরু করেন। ‘আইনের ফাঁক’ দিয়ে ক্যাড়া বাইন মাছের মতো কী করে বের হতে হয় তিনি জাতিকে সেই শিক্ষা হাতে-কলমে দেওয়া শুরু করেন।
ফাঁসির আগের দিন, মানে ১২ নভেম্বর তাঁর মাথা আচমকা ‘আউলা’ হয়ে যায়। তিনি ‘আইনগত’ এমন কিছু আচরণ শুরু করেন, যা কারাগারের নথির ভাষায় ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘অসুস্থতা’। এর ফলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত হয় এবং ওই দিনই দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। দ্বিতীয় দফায় প্রাণভিক্ষার আবেদন গৃহীত হয় এবং আইনগতভাবে তাঁর দণ্ড হ্রাস করা হয়। তাঁকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আসলাম আইনের ফাঁক দিয়ে সুচ হয়ে ঢুকেছিলেন। পরে তিনি ফাল হয়ে বের হওয়ার সব যোগাড়যন্ত্র করে ফেলেন। বিশেষ দিবসে বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দেন সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ। নিলুফার ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সাংসদ ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহর স্ত্রী।
গত ২৫ আগস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান আসলাম। তিন দিন পর ২৮ আগস্ট তিনি ফিরে আসেন নিজের মানিকদহ গ্রামে।
আসলাম ফকিরের এমনই কেরামতি যে তিনি কারাগার থেকে বেরোনোর পরপরই দিব্যি সুস্থ মানুষ হয়ে যান। আচরণে অসুস্থতার ছিটেফোঁটাও নেই। এখন তাঁকে কাজী জাফরউল্যাহ ও তাঁর স্ত্রী সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহর সঙ্গে এলাকার নানা কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে। আসলামের বাড়িতে এখন দর্শনার্থীর ভিড় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। তিনি যখন বাইরে বের হন, তাঁর সঙ্গে থাকে মোটরসাইকেলের বহর।
‘আপনাকে সাজা মওকুফ পেতে কারা সহায়তা করল?’—এই প্রশ্নের জবাবে আসলাম ফকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে আর করবে? লিডার কাজী জাফরউল্যাহ ও তাঁর স্ত্রী সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা কী পারেন।’
কাজী জাফরউল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক। তিনি এর বেশি কিছু মন্তব্য করবেন না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে তো মানসিক রোগী ছিল। এ জন্যই তাকে ক্ষমা করা হয়েছে। এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে, গণসংযোগ করছে, কী বলেন? খোঁজ নিতে হবে তো। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
নিহত ইউপি চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও মামলার বাদী পারুল আক্তারী বলেন, ‘এত বড় অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না।’
সরকার মেনে নিয়েছে, রাষ্ট্র মেনে নিয়েছে, স্থানীয় জনতার একাংশও মেনে নিয়ে ফকির দর্শনে আসলামের বাড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় পারুল আক্তারী ‘মেনে নেওয়া যায় না’ বললেই তো আর হলো না! যা হয়েছে তা আইন মেনে হয়েছে।
পলিটিকসে পলিউশানও হচ্ছে আইন মেনে। আইনের পথ জটিল। মোড়ে মোড়ে বাঁক। বাঁকে বাঁকে বক্তৃতা। বক্তৃতামুখর সেই হাজার মোড়ের হাজার বাঁকের জটিল পথ দিয়ে অন্ধ আইন তার ‘নিজস্ব গতিতে’ চলছে। সে পথে এমন কোনো নিকোলাস মার্শালকে দেখা যাচ্ছে না যে আসলাম ফকিরদের হুঁশিয়ার করে বলবে, ‘আইন অন্ধ হলেও অন্ধকারেও তা দেখতে পায়।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন