মিয়ানমার সঙ্কট ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কে দীর্ঘ দিন ধরে কখনো তীব্র উত্তেজনাময়, কখনো হিম শীতল থাকার টানাপড়েনই প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও পারস্পরিক অবস্থানটি স্বস্তিদায়ক নয়। আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতের নজর অনেক উপরে হওয়ায় দেশটি তার বাড়ির পাশের ছোট প্রতিবেশীর সাথে কিভাবে আচরণ করবে তা বুঝে ওঠতে পারে না। পুরো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এটা ভারতের সমস্যা। ভারসাম্যপূর্ণ দেওয়া-নেওয়ার টেকসই নীতি বিকাশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশটির আকার খুবই বড় হয়ে গেছে। আবার বাংলাদেশ মনে করছে, ভারত ধরে নিয়েছে, যা-ই হোক না কেন ঢাকা তার অনুকূলেই থাকবে এবং মিয়ানমার সঙ্কটে বড় দেশের নীতি প্রমাণ করেছে, সে ছোট দেশের সমস্যাগুলোকে তেমন পাত্তাই দেয় না।
এর ফলে মিয়ানমার/রোহিঙ্গা ইস্যুটি উভয় দেশের অভিন্ন ভবিষ্যত নিয়ে প্রত্যেকের মনে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, যা চীন দূর করার চেষ্টা করতে পারে। বর্তমানের চেয়ে আরো বেশি লাভের আশায় বাংলাদেশের স্বার্থের বিনিময়ে ভারত মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু তাতে নতুন ট্রানজিট রুটসহ কোনো ফলই মেলেনি। গোলযোগপূর্ণ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে যাওয়ার পথ তাকে বৈরী চীনের ছত্রছায়ায় থাকা দোকলামের ‘চিকেন নেক’ করিডোর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করবে।
আরেকটি ট্রানজিট রুটের অস্তিত্ব রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু ‘সুন্নি মুসলিম’ দেশ ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী এলিটদের কাছে অযৌক্তিক ভীতির কারণ হওয়ায় তারা এর ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছে না। তার চেয়েও বড় কথা, বাংলাদেশে প্রবলভাবে উপস্থিতির সিদ্ধান্ত নিয়ে চীন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিচ্ছে। অর্থের বদলে অতি প্রয়োজনীয় নয়- এমন বিকল্প ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। বাংলাদেশে ভারত ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢুকে পড়েছে মিয়ানমার। অথচ দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশে প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল ভারত।
ভারতের জন্য সমস্যা হলো, বাংলাদেশে চীন খুবই জনপ্রিয়। তবে সেটা ভাত খাওয়ার জন্য পরিচিত বাংলাদেশে নুডলসের প্রতি আসক্তি সৃষ্টির কারণে নয়। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে, এই অঞ্চলে ভারত তার বন্ধু বাড়াতে যে কারণেই ব্যর্থ হয়ে থাকুক না কেন। এই পরিস্থিতি ভারতকে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। দেশটি তার নেতৃত্বে অভিন্ন আঞ্চলিক ভবিষ্যতের দিকে যাবে বলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু ওই অবস্থানটির কারণেই এতসব অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়েছে। ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোতে অজনপ্রিয়তা কমানোর কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি ভারত। তবে ভৌগোলিকভাবে দূরের প্রতিবেশী হওয়ায় চীনকে তেমনটা করতে হয় না। সে কেবল ভারতবিরোধী অনুভূতির সুবিধাটি নিচ্ছে।
এই অঞ্চলে ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তাহীনতায় ইন্ধন দিয়েছে চীনের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ফলে প্রতিবেশীদের সাথে কাজ করা ভারতের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ যখন চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কেনে, তখন ভারতীয় মিডিয়া ক্রুদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল, বিশ্লেষকেরা ছিলেন খুবই বৈরী। কিন্তু তুলনামূলকভাবে অপ্রয়োজনীয় এই ক্রয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। কারণ ভারতের চেয়ে চীনকে অনেক ভালো বিকল্প বিবেচনা করা হয়ে থাকে বাংলাদেশে। একটি পরাশক্তির ওপর নির্ভরশীল না থেকে উভয়ের ওপর নির্ভর করে দ্রুত জনপ্রিয়তা হাসিল করার বিষয়টি এখন বেশির ভাগ দক্ষিণ এশিয়ান নেতার জানা হয়ে গেছে।
মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ভারতের ভুল হয়েছে বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমারের সাথে ‘উচ্চতর পর্যায়ের’ বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো। এর ফলে ‘আমরা তোমার পাশে থাকব’ ধরনের গুটিকতেক শব্দ বের হতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল। অথচ ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। বাংলাদেশে বিপুলবেগে প্রবেশ করা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের চেয়ে সন্ত্রাসীদের দিকে মোদির নজরের ফলে যে ভুল হয়েছে, তা হয়তো ভারত পুষিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু এতে ছোট হলেও একটি মূল্য রয়েছে। ঢাকায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের দূতকে হস্তক্ষেপ করে কিছু ত্রাণ এনে ভারতীয় উপস্থিতির মাধ্যমে বিপর্যয় রোখা হয়।
তবে মিয়ানমারের সমালোচনা থেকে দূরে থাকার ভারতের পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিশ্চিতভাবেই মিয়ানমারে তার উচ্চাভিলাষ পূরণে সহায়তা করছে, অবশ্য এখনো হাতে ফল পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই নীতি বাংলাদেশে ফলপ্রসূ হয়নি। বাংলাদেশ নিজেকে চরমভাবে অবহেলিত মনে করায় চীন পূর্ণ সুযোগটি গ্রহণ করেছে। এর ফলে ওবিওআর-এ সই করার সিদ্ধান্তটি বড় ধরনের কোনো বিস্ময় ছিল না।
বাংলাদেশের কোনো সামরিক পরিকল্পনা না থাকায় এবং সীমান্ত সুরক্ষা এবং সীমান্তের অপর পাড়ের বিদ্রোহীদের নিয়ে চিন্তা ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়ায় চীন আরো ভালো প্রস্তাব দিতে পারে। কারণ ভারতের কাছ থেকেতো কোনো প্রস্তাবই আসেনি। সূত্রগুলো জানিয়েছে, চীন একাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দিতে পারে। মিয়ানমারের মন্ত্রীর ঢাকা সফর হয়েছিল চীনেরই আগ্রহে। অন্তত ঢাকায় চীনকে বড় মিত্র হিসেবে গ্রহণ করার ভরসা জেগেছে।
বাংলাদেশ ধীরে ধীরে মেনে নিতে শুরু করেছে, উদ্বাস্তু সঙ্কট খুব দ্রুত নিস্পত্তি হচ্ছে না। ফলে ভারতের সমর্থনের অভাবের বিষষটি ভারতের ওপর কম নির্ভরতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হবে। শেখ হাসিনা অনেক বেশি স্বাধীনভাবে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে চীনের প্রতি ঝোঁক নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি বিচক্ষণ হবে।
ভারত তার সীমান্ত পাড়ের সম্পর্ক আরো ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারে কিনা সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু এখনকার বিষয় হলো, ভারত যেহেতু মিয়ানমারের ওপর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না, চীন তা-ই বাংলাদেশে আরো ব্যাপকভাবে অবস্থান করবে। আর এই সমীকরণে উত্তর-পূর্ব বিষয়টি হয়তো আগের চেয়ে বড় আকারে আবির্ভূত হবে। কারণ ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশের সমর্থন ভারত নিশ্চিতভাবেই পাবে কিনা সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন