রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ শুরু হতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের আলোচনা সাম্প্রতিক বছরগুলোর আলোচনার চেয়ে ভিন্নতর হবে। এর আগের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিরোধী দলের আলোচনা তেমন কোনো অর্থ বহন করেনি। কারণ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অলিখিত সমঝোতা বা বোঝাপড়া ছিল যে, এই সংলাপ লোক দেখানো। এবারে ধারণা করা হয়, এবারের সংলাপের তাৎপর্য ভিন্ন । এর মূল কারণ মনে করা হয়ে থাকে যে, বিএনপি এবারে ভোটে যাবে। তাই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শর্তের মধ্যে কি মিল কি অমিল সেদিকে অনেকেরই নজর থাকবে।
তবে সংসদ রেখে বা ভেঙে নির্বাচন সে বিষয়ে ছোট দলগুলো মিশ্র অবস্থান ব্যক্ত করেছে। এ পর্যন্ত ৩২টি দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সংলাপ করেছে। ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম সংসদ ভেঙে দেয়ার পক্ষে। বাসদ বলেছে সংসদ ভেঙে ভোট করতে, আবার জাকের পার্টি সংসদ রেখে নির্বাচন চেয়েছে। প্রফেসর এমএ মুকিতের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি সংসদ ভেঙে দেয়ার অনুরোধ ইসিকে সরকারের কাছে পৌঁছাতে বলেছে। তবে ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক তরীকত ফেডারেশন বলেছে, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে হবে। সেকারণে সংসদ রেখেই নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, বাহাত্তরের সংবিধানেই বঙ্গবন্ধু সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এমনকি এজন্য সংবিধানে দুটি বিশেষ বিধান যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন জাতির জনক। ওই বিধান থাকার ফলে এমনকি যুদ্ধাবস্থার আশঙ্কার মধ্যেও নির্বাচনে যেতে সংসদ ভেঙে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার বলা হয়েছে, ভেঙে দেয়া সংসদের সদস্যদের মধ্যে যারাই নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন, তারা তাদের সদস্য পদ হারাবেন না। সেকারণে তরীকত ফেডারেশনের সুপারিশ মতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হলেও সংসদ ভেঙে দিলে অসুবিধা নেই।
আগামী ১৫ই অক্টোবর বিএনপি আলোচনা করবে ইসি’র সঙ্গে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার তারিখ ১৮ই অক্টোবরে স্থির আছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রথম আলোচনা হতে যাচ্ছে এই ধারণার ভিত্তিতে যে, নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হতে পারে। বিএনপি যথারীতি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবস্থানে অটল থাকবে। কিন্তু সেই দাবিতে তারা সংকল্পবদ্ধ কিনা সেবিষয়ে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট থাকবে। মনে করা হবে, তারা এটা চাপ দেয়ার জন্য বলছে। সব থেকে জনপ্রিয় মত হলো, বিএনপির সামনে বিকল্প সীমিত। তাই তারা যে কোনো উপায়ে নির্বাচনে যাবে। আর অনেকের মতে এটা ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ যতদূর সম্ভব বিএনপির জন্য প্রতিকূল অবস্থা তৈরির কোনো চেষ্টাই বৃথা যেতে দেবে না। তাদের কৌশল হবে বিএনপিকে নিরুৎসাহিত করা। অনেকে বলছেন, সেনা মোতায়েন বা সেনাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া, রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ক্যাডারদের নিয়োগ করার মতো কণ্টকিত বিষয় ছাড়াও সামনে সংলাপ পর্বে সংসদ ভেঙে নির্বাচন নাকি সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন, এই বিষয়টি উত্তপ্ত বিতর্কের বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে পারে। কারণ বিএনপি এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীরা একটি অভিন্ন স্বার্থের বিষয়কে বড় করে দেখতে একমত হয়েছেন। তার কারণ ক্ষমতাসীন দলের এমপিরা যদি এমপি হিসেবেই ভোট করেন, তাহলে সেটা তাদের নিকটতম প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য একটি বিরাট নেতিবাচক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কারণ এমপি মানেই একটি চলমান প্রভাব। পুলিশই যেখানে বিরাট ফ্যাক্টর, সেখানে এমপিরা প্রত্যেকে পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে চলতে পারবেন, যা তাদের প্রতিপক্ষের জন্য একটি অব্যাহত অস্বস্তির বিষয়। সেকারণে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীরা আশা করতে পারেন যে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন হলে তাদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে তা সহায়ক হতে পারে। এর বাইরে যদি একটি মোটামুটি বা কিছুটা ভিন্নধর্মী নির্বাচনকালীন সরকার পাওয়া যায়, তাহলে তা আরো বেশি রকমের সুবিধা দিতে পারে ক্ষমতা বলয়ের বাইরে থাকা প্রার্থীদের ।
যদিও ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুসারে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের জন্য বাধা-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব বাধা-নিষেধ লঙ্ঘনের দায়ে কাউকেই তেমন সমস্যায় পড়তে হয় না। কারণ লঙ্ঘনের ঘটনার ব্যাপকতা এতটাই বেশি যে, নির্বাচন কমিশনকে তেমন কোনো পদক্ষেপই নিতে দেখা যায় না।
তবে অনেক পর্যবেক্ষক ধরে নিচ্ছেন যে, সামনের নির্বাচনী বৈতরণী আর যাই হোক অতীতের কোনো মডেলে হবে না। একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরির চেষ্টা ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে আন্তরিক হলেও হতে পারে। কারণ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগ আর যাই হোক একেবারে নিশ্চিন্তে বা যাকে বলে হেসে খেলে উপেক্ষা করতে চাইবে না। কিংবা সেটা করার শক্তিও তাদের নেই।
উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা হলো দুটি। প্রথমত সামনে নির্বাচনকে কঠিন মনে করতে হবে। দ্বিতীয়ত যে কোনো ফলাফল মেনে নিতে হতে পারে।
ওই পটভূমিতে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এবং তাদের মিত্রদের অনেকে সামনের সংলাপকে যে কয়েকটি বিষয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করার জায়গা হিসেবে দেখতে চাইবেন তার মধ্যে জ্বলন্ত হতে পারে, সংসদ রেখে না ভেঙে নির্বাচন সেটা ফয়সালা করা। তবে এটা ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরিষ্কার করছেন যে, সামনের নির্বাচনও সংসদ রেখেই করা হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো ইঙ্গিত ক্ষমতাসীন দলের নেই।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন এই প্রশ্নে একটি বক্তব্য দিতে পারে বলে মনে করা হয়। কারণ সংসদ রেখে না রেখে নির্বাচন সেই বিষয়ে সংবিধান তাকে কথা বলার একটা সুযোগ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু নির্বাচন করা। এবং সেটা কি উপায়ে বা কখন হবে সেই বিষয়ে তারা সরকারকে সুপারিশ দিতে পারে। তবে সেটা রাখা বা না রাখা সেটাও আবার সরকারের সাংবিধানিক এখতিয়ার। তবে যেটা এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো এখনই নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে এই বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারে কি পারে না, সেই প্রশ্ন ফয়সালা করা।
সরকার ও বিরোধী দলের সূত্রে এই প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী অবস্থানের একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কিন্তু তারপরেও সামনের সংলাপে বিএনপি তার মিত্রদের নিয়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনে জোর দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। গত আগস্টের গোড়ায় প্রফেসর বি. চৌধুরীর বাসভবনে বিরোধীদলীয় একটি নির্বাচনী মোর্চার বৈঠবে জাপা’র কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল। সেখানেও কথা হয় যে, তারা নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ প্রশ্নে একটি অবস্থান নেয়ার জন্য অনুরোধ করতে পারে।
১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-দফাটি নিচে দেয়া হলো:
এতে বলা আছে: ১২৩ (৩) সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে
(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে: তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।] (৪) সংসদ ভাংগিয়া যাওয়া ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদের কোন সদস্যপদ শূন্য হইলে পদটি শূন্য হইবার নব্বই দিনের মধ্যে উক্ত শূন্যপদ পূর্ণ করিবার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।
তবে শর্ত থাকে যে, যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, কোন দৈব-দুর্বিপাকের কারণে এই দফার নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, কখন সংবিধানমতে সংসদ ভেঙে দেয়া হবে, সেটা প্রধানমন্ত্রীর উপরে নির্ভর করছে। প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে পরামর্শ দিতে হবে। আর তখনই রাষ্ট্রপতি সেবিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ মতে নির্বাচন কমিশন কোনো পরামর্শই দিতে পারবে না। এই অধিকার সাংবিধানিক। এবং নির্বাচন কমিশনের সেটা আছে। যদিও তারা এই এখতিয়ার এর আগে কখনো প্রয়োগ করেনি।
১২৬ অনুচ্ছেদ বলেছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হইবে।
অবশ্য অনেকে কৌতূহলের বশে প্রশ্ন রাখছেন যে, সরকারি দল এবারে বরং সংসদ বহাল রাখতে নতুন একটি যুক্তি দিতে পারে। তারা বলতে পারে, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা অন্তত তত্ত্বগত বিবেচনায় কোনো চরমতম জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করতে হতে পারে। তাই সংসদকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এটা জাতীয় নিরাপত্তাগত প্রশ্ন। সংসদ ভেঙে দিলে তা ডাকতে বিলম্ব, অসুবিধা বা জটিলতা হতে পারে।
মন্তব্য চাওয়া হলে একজন বিশ্লেষক বলেছেন, এর উত্তর জাতির জনকের নেতৃত্বে তৈরি করা বাহাত্তরের সংবিধানেই আছে। যুদ্ধের চেয়ে চরম জরুরি অবস্থা কোনো একটি জাতির জীবনে কমই আসতে পারে। সেই যুদ্ধাবস্থার সময়ে দরকার হলে ৫ বছর সংসদের মেয়াদ বাড়ানোর পথও বাতলে দেয়া আছে। ৫ বছরের সংসদের মেয়াদ তখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়তে পারার মতো পরিস্থিতিও কল্পনা করা হয়েছে। কারণ সংবিধান বলেছে, সংসদের মেয়াদ তখন এক দফায় অনধিক এক বছর করে বাড়ানো যেতে পারে। নির্বাচন না দিয়ে এরকম কতবার মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে তার কোনো উল্লেখ সংবিধানে নেই। শুধু শর্ত হলো ‘‘যুদ্ধ সমাপ্ত’’ হওয়ার পরে ৬ মাসের বেশি হবে না।
ওই বিশ্লেষক বলেন, এমনকি নির্বাচনের কারণে সংসদ ভেঙে দিতেও বিশেষ বিধান সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্বাচনের কারণে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরে যদি দরকার পড়ে তাহলে যে কোনো সময় ভেঙে দেয়া সংসদকে পুনরায় আহ্বান করা যাবে। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার স্বার্থে ১৯৭২ সালেই এই বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে। তবে শর্ত থাকে যে, প্রজাতন্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত থাকিবার কালে সংসদের আইন-দ্বারা অনুরূপ মেয়াদ এককালে অনধিক এক বৎসর বর্ধিত করা যাইতে পারিবে, তবে যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে বর্ধিত মেয়াদ কোনোক্রমে ছয় মাসের অধিক হইবে না। ৭২ অনুচ্ছেদের (৪) উপ-দফা বলেছে, ‘সংসদ ভঙ্গ হইবার পর এবং সংসদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, প্রজাতন্ত্র যে যুদ্ধে লিপ্ত রহিয়াছেন, সেই যুদ্ধাবস্থার বিদ্যমানতার জন্য সংসদ পুনরাহ্বান করা প্রয়োজন, তাহা হইলে যে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইয়াছিল, রাষ্ট্রপতি তাহা আহ্বান করিবেন।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন