শ্রমিক ভিসায় লিবিয়ায় যেতে কোনো খরচ লাগবে না। পাসপোর্ট না থাকলে করে দেওয়া হবে। ভিসা, বিমান ভাড়া ও লিবিয়ায় প্রথম মাস থাকা-খাওয়ার খরচ দেওয়া হবে- এমন প্রলোভন দেখিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের লিবিয়ায় নিয়ে বন্দিশালায় আটকে দেশে থাকা স্বজনের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করছে আন্তর্জাতিক অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা। চাকরিপ্রত্যাশীরা এ দেশ থেকেই যে অপহরণকারীদের ফাঁদে পা দিচ্ছে, তা লিবিয়ায় বন্দিশালায় আটকের আগপর্যন্ত ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছে না। যখন বুঝতে পারছে, তখন আর কিছুই করার থাকছে না। মুক্তিপণের টাকা না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দিনে একবেলা পেটভরে খাবারও জোটে না তাদের। লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় এমন অন্তত অর্ধশত বাংলাদেশি আটক আছেন। তাদের প্রত্যেককে শ্রমিক ভিসায় বিনা খরচে সে দেশে নিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা। লিবিয়ায় গিয়ে চাকরির পর মাসিক কিস্তিতে খরচের টাকা পরিশোধের কথা বলা হয়েছিল তাদের।
এই অপহরণকারী চক্রের মূল হোতা লিবিয়াপ্রবাসী নোয়াখালীর কাজী ইসমাইল ওরফে কাজী সাহেব। সেখানে তার সহযোগী রয়েছে সাইফুল, সোহাগ, আফজালসহ পাঁচজন। দেশে রয়েছে অন্তত ২৫ সদস্য। সম্প্রতি লিবিয়ায় ইসমাইলের বন্দিশালা থেকে উদ্ধার হয়ে আসা মানিকগঞ্জের মুন্না নামের এক তরুণ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন সমকালের কাছে। তাকেও বিনা খরচে অপহরণকারী চক্রের এ দেশের সদস্যরা লিবিয়ায় পাঠিয়েছিল শ্রমিক ভিসায়। তার পাসপোর্ট করার খরচও দিয়েছিল তারা। তাকে বলা হয়েছিল, লিবিয়ায় যেতে নগদ টাকা লাগবে না। সেখানে চাকরির পর মাসিক কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু তাকে সেখানে নিয়ে কোনো চাকরি দেওয়া হয়নি। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বন্দিশালায় নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এ চক্রের এ দেশের এক সদস্য বাগেরহাটের এম এ হান্নান ওরফে মল্লিক হান্নানকে গ্রেফতারের পর চক্রের মূল হোতাসহ অন্য সদস্যদের নাম বেরিয়ে আসে। বিনা খরচে লিবিয়ায় মানুষ পাঠিয়ে আটক রেখে মুক্তিপণ আদায়ের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে হান্নান।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা মহানগরের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, দরিদ্রদের বিনা খরচে লিবিয়ায় নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করে- এমন চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ চক্রের দেশে অন্তত ২৫ ও লিবিয়ায় ছয়জন সদস্য রয়েছে। দলের প্রধান লিবিয়াপ্রবাসী নোয়াখালীর কাজী ইসমাইল। মানুষকে বিনা খরচে শ্রমিক ভিসায় লিবিয়ায় নিয়ে যায় তারা। নিয়ে যাওয়ার সময় বলা হয়, লিবিয়ায় কাজ করে টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু কাজ না দিয়ে সে দেশের বিমানবন্দর থেকে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে। নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে মোবাইল ফোনে এ দেশে স্বজনদের দেখিয়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করে। সম্প্রতি এ চক্রের দেশের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। লিবিয়ায় যারা বন্দি আছে, তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
যেভাবে অপহরণ করা হয় মুন্নাকে :মুন্নার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পূর্ব আড়পাড়ায়। দরিদ্র বাবা সাজু উদ্দিন শেখ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। দুই ভাই ও এক বোন। ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। ভিটে ছাড়া কোনো জমি-জায়গা নেই। অভাবের সংসারে দুই ভাই রাজধানীর ফকিরাপুলে পৃথক দুটি ছাপাখানায় চাকরি করতেন। মুন্না জানান, তিনি ফকিরাপুলের কমিশনার গলির একটি মেসে থাকতেন। একই মেসে থাকতেন অপহরণ চক্রের সদস্য সহিদুল ইসলাম সহিদ। তার বাড়ি নওগাঁর ভান্ডার গ্রামে। মেস মেম্বার পরিচয়ের সূত্র ধরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রমিক ভিসায় মুন্নাকে বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব দেয় সহিদ। বিদেশে যাওয়ার মতো টাকা-পয়সা নেই বলে তাকে জানিয়ে দেন মুন্না। সহিদ তাকে বলে, টাকা-পয়সা নগদ লাগবে না। বিদেশে গিয়ে চাকরির পর টাকা পরিশোধ করার সুযোগ আছে। পাসপোর্টও সে করে দেবে বলে জানায় মুন্নাকে। বাকিতে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া না করে রাজি হয়ে যান তিনি। এরপর মুন্নাকে চক্রের অপর দুই সদস্য এম এ হান্নান ও সুমনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সহিদ। তারা ময়মনসিংহ থেকে নিজেদের টাকায় মুন্নার পাসপোর্ট করে দেয়। এরপর মার্চ মাসে তাকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। লিবিয়ার ত্রিপোলি বিমানবন্দর থেকে এক লিবিয়ান তাকে রিসিভ করে। গাড়িতে প্রায় এক ঘণ্টা যাওয়ার পর গোডাউনের মতো একটি বড় ঘরে তাকে নিয়ে ছয় বাংলাদেশির হাতে তুলে দেয়। ১০-১২ লিবিয়ান বড় আঘ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ওই বন্দিশালা পাহারায় থাকে। বন্দিশালায় ফ্যান নেই, জানালা বন্ধ। এ অবস্থায় অন্তত ৫০ বাংলাদেশিকে আটক অবস্থায় দেখে মুন্না বুঝতে পারেন, তিনিও আটকা পড়েছেন। ভীত হয়ে পড়েন তিনি। বন্দিশালা নিয়ন্ত্রণ করে কাজী ইসমাইল। তার বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। কাজী ইসমাইল বন্দিশালায় কাজী সাহেব নামে পরিচিত।
মুন্নাকে দু'দিন পর বন্দিশালার মধ্যে একটি টর্চার সেলে নিয়ে যায় ইসমাইল ও তার লোকজন। সেখানে লোহার পাইপ দিয়ে তাকে পেটানো হয়। মারধর করার সময় মোবাইল ফোনে ভিডিওকলে এ দেশে তার বড় ভাই জিন্নাহকে দেখিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে টাকা দাবি করে। মুন্না বলেন, দিনে দু'বার তাকে টর্চার সেলে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। চিৎকার করলে মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে পেটাত। বলত, যত দ্রুত টাকা দিবি, তত দ্রুত ছাড়া পাবি। সাত মাস মুন্না নির্যাতনের শিকার হন। মুন্না বলেন, মুক্তিপণের দাবিতে বন্দি থাকা সবাইকে দিনে দু'বার টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করে ইসমাইল ও তার লোকজন।
পিবিআইর এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি চক্রের এ দেশের সদস্য হান্নানকে গ্রেফতার করে পিবিআই ঢাকা মহানগরের একটি দল। তার লোকজন অপহরণকারী চক্রের প্রধানের সঙ্গে লিবিয়ায় যোগাযোগ করলে গত ৩ অক্টোবর মুন্নাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন