দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই করেন ওপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশ ধনী। আর মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশ করেন সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। যদিও সামগ্রিকভাবে দেশের দারিদ্র্য কমেছে। যেমন, গত ছয় বছরে সার্বিক দারিদ্র্যের হার সাড়ে ৩১ শতাংশ থেকে কমে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। মূলত ধনী-গরিব নির্বিশেষে আয় বৃদ্ধির কারণেই দারিদ্র্য কমেছে। তবে এই আয় বৃদ্ধির দৌড়ে গরিবের চেয়ে ধনীরাই বেশি এগিয়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানার আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপ-২০১৬-তে এই চিত্র পাওয়া গেছে। গতকাল মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। আগারগাঁওয়ের বিবিএস মিলনায়তনে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এই জরিপ করা হয়েছে। সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর পর পর এই জরিপ করা হয়। এবারে জরিপের তথ্য অবশ্য ২০১৬ সালের।
সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশের আয় মোট আয়ের ১%
*গ্রামে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি
*ভাত খাওয়া কমেছে
*জানুয়ারি–মার্চে গরিব বাড়ে
*কুড়িগ্রামে সবচেয়ে বেশি গরিব, কম নারায়ণগঞ্জে
দেশে অতি দারিদ্র্যের হারও কমেছে। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে অতি দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, যা বিশ্বের গড় দারিদ্র্যের হারের চেয়ে কম। বিশ্বের গড় দারিদ্র্যের হার ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২০ লাখ। সেই হিসাবে, দেশে ৩ কোটি ৯৩ লাখ দরিদ্র মানুষ আছে। হতদরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৮ লাখ।
মৌলিক চাহিদার ব্যয় (কস্ট অব বেসিক নিডস) পদ্ধতির মাধ্যমে দারিদ্র্য পরিস্থিতি পরিমাপ করেছে বিবিএস। জরিপ করে খানা বা পরিবারের আয়-ব্যয়, ভোগ, পুষ্টিমান, জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদির তথ্য নেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি যদি দিনে ২ হাজার ১২২ কিলোক্যালরির খাবার কেনার সামর্থ্যের পরও কিছু টাকা খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ করতে পারেন, তাহলে তাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন বলে ধরে নেওয়া হয়। আর যাঁদের দৈনিক মোট খরচ করার সামর্থ্য ২ হাজার ১২২ কিলোক্যালরি খাদ্য কেনার সমান, তাঁরা হতদরিদ্র।
দারিদ্র্য কমার গতি কমেছে
জরিপ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার কমার প্রবণতা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। পরের পাঁচ বছরে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশীয় মানে কমে দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। আর ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। ২০০৫ থেকে ২০১০ সময়ে প্রতিবছর গড়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশীয় মানে দারিদ্র্য কমেছে। এরপরের ছয় বছরে দারিদ্র্য কমেছে গড়ে ১ দশমিক ২ শতাংশীয় মানে।
গ্রামে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে বেশি
প্রতিটি পরিবারের আয় যেমন বেড়েছে, খরচও বেড়েছে। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে মাসিক গড় আয় বেড়েছে ৪ হাজার ৪৬৬ টাকা। সার্বিকভাবে শহরের একটি পরিবার এখন গ্রামের আরেকটি পরিবারের চেয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি আয় করে। শহরের পরিবারের গড় আয় ২২ হাজার ৫৬৫ টাকা, গ্রামের পরিবারের আয় ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা।
এবার আসি খরচ কোথায় কেমন। বিবিএস বলছে, গ্রামের একটি পরিবার মাসে যত আয় করে, এর চেয়ে বেশি খরচ করে। গ্রামের পরিবার মাসে গড়ে ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা ব্যয় করে, যা আয়ের চেয়ে ৮০৩ টাকা বেশি। শহরের পরিবারের গড় খরচ ১৯ হাজার ৬৯৭ টাকা। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে একটি পরিবারকে সংসার চালাতে মাসে গড়ে ১৫ হাজার ৯১৫ টাকা খরচ করতেই হয়।
ভাত খাওয়া কমেছে
এ দেশের মানুষ আগের চেয়ে ভাত কম খায়। তবে শাকসবজি, ডাল, মাংস ও ডিম খাওয়া বেড়েছে। ২০১০ সালে একজন মানুষ দিনে গড়ে ৪১৬ গ্রাম চাল বা ভাত খেত। ২০১৬ সালের জরিপে দেখা গেছে, এখন তারা দিনে গড়ে ৩৬৭ গ্রাম চাল বা ভাত খায়। এর ফলে সার্বিকভাবে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে গেছে। এখন দিনে একজন মানুষ ৯৭৬ গ্রাম খাবার খায়। ২০১০ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ কেজি বা ১ হাজার গ্রাম।
দেশের মানুষের খরচের খাতগুলোও পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে মোট খরচের ৫৪ শতাংশই খাবার কেনায় যেত। এখন তা কমে ৪৭ শতাংশ নেমে এসেছে। বিবিএস বলছে, প্রথমবারের মতো খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় খাদ্যের তুলনায় বেড়েছে, যা উন্নয়নের একটি অন্যতম নির্দেশক।
আয় বৈষম্য বেড়েছে
গরিবদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ কমে গেছে, ধনীদের তা বেড়েছে। বিবিএস বলছে, দেশের সব মানুষের যত আয়, এর মাত্র ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ আয় করেন সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। ছয় বছর আগেও মোট আয়ের ২ শতাংশ এই শ্রেণির মানুষের দখলে ছিল।
অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ছয় বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বিবিএস জরিপে আরও বলা হয়েছে, দেশের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মালিক ওপরের দিকে থাকা ৩০ শতাংশ মানুষ।
সবচেয়ে বেশি গরিব কুড়িগ্রামে, কম নারায়ণগঞ্জে
এবারের খানার আয় ও ব্যয় জরিপে প্রথমবারের মতো জেলা পর্যায়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতি দেখানো হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ কুড়িগ্রামে প্রতি ১০০ জনে ৭০ জনের বেশি গরিব। সবচেয়ে কম গরিব মানুষ থাকে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। সেখানে দারিদ্র্য মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
রাজধানী ঢাকায় প্রতি ১০ জনে একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। অন্যদিকে চট্টগ্রামে দারিদ্র্যের হার ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
জানুয়ারি-মার্চে গরিব মানুষ বাড়ে
এবারের খানা জরিপে প্রান্তিকভিত্তিক দারিদ্র্যের হার কেমন—তাও তুলে ধরা হয়েছে। জরিপটি ২০১৬-১৭ অর্থবছর জুড়ে করা হয়েছে। জরিপের হিসাবে দেখা গেছে, জানুয়ারি-মার্চ মাসে দেশের গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। ওই তিন মাসে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে ২৭ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বাস করেন। এ সময় কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে কম। আবার এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে গরিব মানুষের সংখ্যা কমে যায়। ওই সময়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন সাড়ে ২২ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া জুলাই-সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এই হার যথাক্রমে ২৩ শতাংশ ও ২৬ দশমিক ১ শতাংশ।
আলোচনা
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এ দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হয়েছে। আগের চেয়ে তাঁরা ভাত কম খাচ্ছেন, কার্বোহাইড্রেট কম খাচ্ছেন। এতে বেশি দিন বাঁচবেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে হতদরিদ্রের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় এই হার ১৬ শতাংশ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির কারণেই দারিদ্র্য কমছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এই জরিপের ভালো ও খারাপ দুটি দিকই আছে। ভালো দিক হলো, দারিদ্র্য কমেছে, ভোগ ব্যয় বেড়েছে। আবার খারাপ দিক হলো, দারিদ্র্য কমার গতি কমেছে। আয় বৈষম্যও বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর রাজশ্রী পালালকার বলেন, ২০০০ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত বাংলাদেশ দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে, যা একটি বিরাট সাফল্য। তখন প্রতি দুজনে একজন গরিব মানুষ ছিল। কত মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠল, নীতিনির্ধারণের জন্য তা জানা দরকার।
অনুষ্ঠানে এই জরিপ প্রকল্পের পরিচালক দীপঙ্কর রায় জরিপটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এ ছাড়া বক্তব্য দেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব কে এম মোজাম্মেল হক, বিবিএসের মহাপরিচালক আমীর হোসেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন