একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দল, বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের সঙ্গে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত ৩১ জুলাই সুশীল সমাজ, ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর ২৪ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে নির্বাচন কমিশন।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে সংলাপ প্রক্রিয়া। এ পর্যন্ত ৩৮টি ও শেষ দিনের দুটিসহ মোট ৪০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে ইসি।
বিশিষ্টজন ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের সংলাপের এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে আসা প্রস্তাব কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। যেটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। তবে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন করণীয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়ন করতে চাইলে সংসদ ও সরকারের ইচ্ছা ও সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে বল এখন নির্বাচন কমিশনের ‘কোর্টে’।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এগুলো প্রক্রিয়া থেকে তো কোনো ফলাফল আসে না। ফলাফল আসবে যখন নির্বাচন কমিশন এগুলোকে তৈরি করে কার্যকর কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সেটার ওপর যখন নির্বাচন হবে তখন ফলাফল আসবে। আলোচনা করছে কী করবে, কী করবে না এটার ওপর, রাজনৈতিক দলগুলো কী চায় এটা জানার জন্য। আলোচনাকে তো কোনো ফলাফল বলা চলে না।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন পদক্ষেপ কী নেবে সেটার ওপর নির্ভর করবে। আইন-কানুন হলে তো হবে না। সেটা প্রয়োগ করতে কতখানি সুবিধা-অসুবিধা হবে সেগুলোর ওপর নির্ভর করবে। প্রস্তাব দিয়ে তো কিছু হয় না। আইন বদলাতে হলে তারা (নির্বাচন কমিশন) প্রস্তাব করবে সংসদকে। সংসদ যদি না বদলায় তাহলে তো কিছু করণীয় নেই। আইন তো নির্বাচন কমিশন বানায় না, সুতরাং তারা শুধু প্রস্তাব দিতে পারে।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, নির্বাচন কমিশন একটা সাংবিধানিক বডি। বর্তমান কমিশন একটা নবগঠিত কমিশন। তারা দায়িত্ব নেয়ার পরে একটা রোডম্যাপ প্রণয়ন করছেন। সেটার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু অন্যতম প্রধান স্টেক হোল্ডার তাদেরকে সংলাপে বসতে আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দল যে যার মতো হোমওয়ার্ক করছে। হোমওয়ার্ক করে তাদের চিন্তার ফসল কমিশনের কাছে হাজির করছেন। কমিশন সেটা গ্রহণ করছে। তারা যেদিন প্রথম সুশীল সমাজের সঙ্গে বসেন, সেদিন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এ সমস্ত প্রস্তাব যেগুলো আসছে সেগুলো একসঙ্গে করে পুস্তক আকারে প্রকাশ করবেন। ফলে এটা রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে শুধু নির্বাচন কমিশনের জন্য কাজে লাগবে না সমগ্র জাতির জন্য ইতিহাসে রেফারেন্স পয়েন্ট হয়ে থাকবে। এটা নিঃসন্দেহে একটা মহৎ উদ্যাগ।
তিনি বলেন, ড. হুদার যে কমিশন ছিল, ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় গঠিত। তারা দায়িত্ব নিয়েই বলেছিল, এই কমিশনের কোনো ইনস্টিটিউশনাল মেমোরি নেই। আগের কোনো কাগজপত্র, দালিলিক-প্রামাণিক লিপিবদ্ধ নেই। ওই শূন্যতা এই প্রক্রিয়ায় পরিপূর্ণ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। অনেকগুলো বিষয় কমন পাওয়া যাবে। সবগুলো মোটা দাগে ফেললে অনেক কমন পাওয়া যাবে। একটা খসড়া তারা তৈরি করতে পারেন, সেটা ডকুমেন্ট হিসেবে কাজে লাগবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই সংলাপের ফলাফল নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের উপর। নির্বাচন কমিশন সবার কথা শুনল। এখন তাদেরই দায়িত্ব সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করা। তার প্রেক্ষিতে এখন তারা (নির্বাচন কমিশন) সিদ্ধান নেবে কোনগুলো তারা গ্রহণ করবে, কোনগুলো করবে না। সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে কিছু পরিবর্তনের জন্য সরকারকে অনুরোধ করতে পারে। নিজেরা কিছু পরিবর্তন করতে পারে যেগুলো তারা গ্রহণ করবে। বল এখন নির্বাচন কমিশনের কোটে। তাদের মানদণ্ড ভিন্ন। কোনগুলো গ্রহণ করলে, কোনগুলো পরিবর্তন করলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এ ব্যাপারে তাদের (নির্বাচন কমিশন) সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কমিশনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে তিনি বলেন, কতগুলো জিনিস নির্বাচন কমিশন নিজেরা করতে পারে না। যেমন নির্বাচনকালীন সরকার পরিবর্তন, সংসদ বাতিল করা এসব তারা করতে পারে না। কিন্তু তারা (নির্বাচন কমিশন) যদি মনে করে এগুলো ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে না, তাহলে তারা সরকারকে বলতে পারে। সরকার শোনে, না শোনে সেটা ভিন্ন কথা। সরকার যদি না শোনে, তারা বলতে পারে আমরা এ অবস্থায় নির্বাচন করব না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান শেলী বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি রয়েছে এবং যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল গত প্রায় এক দশক ধরে কায়েম করেছে, সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠান যতই সাংবিধানিক হোক নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য তাদের বিশেষ কিছু করার নেই। এখানে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সরকার যদি চান অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, যদি না চান তাহলে সম্ভব নয়। সরকারি দল যদি বিরোধী দলে যারা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বাভাবিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন তাহলেই নির্বাচন কমিশন কিছু করতে পারবে। অযথা সেনা মোতায়েন, সংসদ ভেঙে দেয়ার এ সমস্ত দাবি নিরর্থক ও তাৎপর্যহীন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন