কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ ফাহিম (২০)। কয়েক মাস আগে ছুটিতে ঢাকায় আসেন। গত ২৬শে আগস্ট বন্ধুকে শেষ বিদায় দিতে বাসা থেকে বের হন। আড্ডা দেন বাসার পাশে ধানমন্ডির একটি রেস্তরাঁয়। রাত ৮টার দিকে বাসায় ফেরার জন্য রওনা দেন। কিন্তু তিনি আর বাসায় ফেরেননি।
ইশরাকের বাবা মো. জামাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, তিন ছেলের মধ্যে সবার বড় ইশরাক। কানাডার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টার শেষ করে ছুটিতে এসেছিলো। সে বাসা থেকে খুব একটা বের হতো না। নিখোঁজ হওয়ার দিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সে তার মাকে বলেছিলো, এক বন্ধু বিদেশে যাবে। তাই তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। ৩রা সেপ্টেম্বর কানাডা যাওয়ার কথা ছিল তার। ইশরাকের বাবা আরো বলেন, পরিবারের বড় ছেলে নিখোঁজের পর থেকে তাদের পরিবারের সব আনন্দ মিইয়ে গেছে। তার মা’র চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। ছেলে নিখোঁজের জন্য তারা কাউকে সন্দেহও করছেন না। কারণ তাদের কোনো শত্রু নেই। এ ব্যাপারে ধানমন্ডি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবদুুল লতিফ বলেন, ঘটনার পরপরই ইশরাকের বাবা থানায় জিডি করেছেন। তারপর থেকেই তার সন্ধানে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইশরাকের সকল বন্ধুদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু ইশরাক নয়, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। যার বেশিরভাগেরই কোনো হদিস মেলেনি। আবার যারা ফিরে এসেছেন তারা কোথায় ছিলেন, কে বা কারা আর কেনোই বা তাদের নিয়ে গিয়েছিলো সে ব্যাপারে একেবারেই মুখ খুলছেন না।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর শ্রীমঙ্গলে উদ্ধার হন সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র রুকনুজ্জামান রুকন। তিনি ফিরে আসলেও ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয়নি এতোদিনেও। ২৩শে আগস্ট পল্টনের খানা বাসমতি রেস্তরাঁর সামনে থেকে তুলে নেয়া হয় আইএফআইসি ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদকে। তিনি ২৯শে আগস্ট মঙ্গলবার বাসায় ফিরেছেন। পরে তার স্ত্রী শিল্পী আহমেদ পল্টন থানায় আরেকটি জিডি করেছেন। জিডিতে উল্লেখ করা হয়, কারও বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। তবে এতদিন শামীম কোথায় ছিলেন, এ বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২৮শে আগস্ট রাত সাড়ে নয়টার দিকে একটি মাইক্রোবাসে করে এনে শামীমকে মতিঝিল এলাকায় রেখে যায় অপহরণকারীরা। পুলিশকে এর বেশি কিছু পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়নি।
এভাবেই বাসা বা কর্মস্থল থেকে বের হয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে মানুষ। কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আবার কখনো অজ্ঞাতপরিচয়ে তুলে নেয়া হচ্ছে তাদের। এসব রহস্যজনক নিখোঁজের পর কেউ ফিরে আসছেন, আবার কেউ ফিরছেন না। যারা ফিরে আসছেন তারা মুখ খুলছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের শুধু ২২ থেকে ২৭শে আগস্ট পর্যন্ত ছয়দিনে রাজধানীর বিভিন্ন রাজপথ থেকে তাবলিগে আসা তিনজন, দুই ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থী ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ মোট ৮ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজনকে পরবর্তী সময়ে চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় রাজধানীর রাজপথে ফেলে যাওয়া হয়। কিন্তু ২৭শে আগস্ট বিকালে রাজধানীর গুলশানে অপহরণকারীরা সবার সামনে থেকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায় ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশের বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ রায়কে। ঘটনার পর গুলশান থানায় একটি জিডি করেন অনিরুদ্ধ রায়ের ভাগ্নে কল্লোল হাজরা। সেখানে উল্লেখ করা হয় রোববার সাড়ে ৪টার দিকে গুলশান ১ নম্বরের পাশে ইউনিয়ন ব্যাংকের সামনে থেকে ডিবি পরিচয়ে অনিরুদ্ধ রায়কে তুলে নেয়া হয়। এ সময় তার গাড়িচালকও সঙ্গে ছিলেন। তবে গাড়িচালককে তারা রেখে যায়। এরপর গাড়িচালক বিষয়টি অনিরুদ্ধ রায়ের বাসায় জানালে তারা এসে গুলশান থানায় বিষয়টি অবহিত করেন। অনিরুদ্ধ রায় এখনো নিখোঁজ। একইদিন নিখোঁজ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, ২২শে আগস্ট ছেলের সামনে থেকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নেয়া ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাতের এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এসব অপহরণকারীর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও তেমন কোনো তথ্য নেই। মিলছে না তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। অন্যদিকে যারা ফিরে আসছেন তারাও ভয়ে মুখ খুলছেন না। এমনকি অপহৃতদের পরিবারও অজানা আশঙ্কায় কোনো কথা বলতে নারাজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গুম হওয়া ১০টি দেশের একটি। সামপ্রতিককালে দেশে ক্রসফায়ার বন্ধ হওয়ার পর থেকে গুমের ঘটনা বেড়ে গেছে। এছাড়া নিখোঁজ হওয়ার পর ফিরে আসলে এর কারণ অনুসন্ধান করা হয় না। যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায়ও আনা হয় না। তিনি বলেন, গুম বন্ধের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এটা খুব উদ্বেগের বিষয়। একইসঙ্গে সরকারের জন্যও ভালো না। নাগরিক হিসেবে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। বাসা থেকে বের হলে আর ফিরতে পারবো কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। আগে রাজনীতিবিদদের গুম করা হতো। আর এখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ সব ধরনের ব্যক্তিদের গুম করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিক রুল মেনে এসব বিষয়ে ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে। এছাড়া আর কারো ক্ষমতা নেই।
এসব বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, রাষ্ট্রকেই নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হবে। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা আশা করি, পুলিশ প্রশাসন নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করবে এবং যারা এসব ঘটনায় জড়িত তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আগের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে যদি শাস্তি নিশ্চিত করা যেতো তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন