চল্লিশ মেট্রিক টন ভার উত্তোলনের ক্ষমতা আছে- এমন তথ্য দিয়ে ১০ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পম্ন দুটি রেকার কিনছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি)। এ ধরনের রেকারের বাজারমূল্য সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা। তবে এগুলোর প্রতিটি কেনা হচ্ছে সোয়া তিন কোটি টাকায়। রেকার দুটিও এরই মধ্যে দেশে চলে এসেছে। যে কোনো সময় সেগুলো গ্রহণ করবে বিআইডব্লিউটিসি। রেকার ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির এক সদস্য এই অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখিত আপত্তি জানিয়ে কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন। রেকারগুলোর নিম্নমান সম্পর্কেও লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন তিনি। তবে রেকার সরবরাহকারী ঠিকাদার ও বিআইডব্লিউটিসির শীর্ষ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে রেকার দুটি নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।
নদীবন্দরের পন্টুন স্থানান্তর বা ফেরিতে ওঠানামার সময় বিকল যানবাহনকে টেনে তোলার কাজে ব্যবহারের জন্য গত বছরের শেষদিকে দুটি রেকার কেনার উদ্যোগ নেয় বিআইডব্লিউটিসি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৪০ টন পুলিং ক্যাপাসিটি (টেনে নেওয়ার ক্ষমতা) ও ৪০ টন লিফটিং ক্যাপাসিটির (ভার উত্তোলনের ক্ষমতা) রেকার কেনা হবে। দরপত্রের মাধ্যমে রেকার সরবরাহের কাজ পায় মহাখালী নিউ ডিওএইচএসের ২৯ নম্বর সড়কের ৪০৭ নম্বর হাউসের মেসার্স বেল্লাল
অ্যান্ড ব্রাদার্স।
রেকার ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির পাঁচ সদস্য গত মার্চ মাসে পূর্বজাহাজীকরণ পরিদর্শনের (প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন) জন্য রেকার দেখতে চীনে যান। মান পরীক্ষার সময় কমিটিভুক্ত সদস্য, বিআইডব্লিউটিসির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দেখেন, রেকার দুটির পুলিং ক্যাপাসিটি কোনোমতে ৪০ টনের হলেও লিফটিং ক্যাপাসিটি তা নয়। তারা দেখেন, আট ইঞ্চি উপরে ওঠাতেই রেকারের পেছনের ট্রিগার উঁচু হয়ে যাচ্ছে এবং প্রচণ্ডভাবে কাঁপছে। এ অবস্থায় কমিটি রেকার দুটিকে অনুপযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে ফিরে আসে। গত ২০ মার্চ রেকার ক্রয় প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বিআইডব্লিউটিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল গফুর সরকার চিঠি দিয়ে সরবরাহকারীকে বিষয়টি জানান। রেকার দুটি দেশে আনার আগেই লিফটিং ক্যাপাসিটি ৪০ টন নিশ্চিত করার অনুরোধ করেন তিনি। কিন্তু একপর্যায়ে রহস্যজনক কারণে কমিটির সদস্যরা ওই রেকার দুটিই নেওয়ার পক্ষে সম্মতি দেন। সম্প্রতি রেকার দুটি এনে একটিকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে, অন্যটিকে ভোলার ইলিশা ফেরিঘাটে রাখা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক আবদুল গফুর সরকার সমকালকে জানান, ক্রয় কমিটির সদস্যদের পরিদর্শনের সময় রেকার দুটি প্রস্তুত ছিল না। এখন হয়তো কোম্পানি সেগুলো ঠিক করে দিয়েছে। কমিটির সদস্যরা ভালো করে দেখে রেকার দুটি গ্রহণ করবেন।
এদিকে, রেকার দুটি আমদানির অনুমতি দেওয়ার পরই কমিটির অন্যতম সদস্য বিআইডব্লিউটিসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) নুরুল হুদা এতে আপত্তি দেন। বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে রেকার দুটির মানহীনতার কথা জানান তিনি। চিঠিতে তিনি জানান, চীনের ফ্যাক্টরিতে রেকার দুটির সক্ষমতা যাচাইকালে ২১ দশমিক ৬০ টনের একটি কংক্রিট স্লাব দু'দিন চেষ্টা করেও ভূমি হতে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চির বেশি উত্তোলনে সক্ষম হয়নি। সেটি করতেই রেকারের সামনে ও পেছনের ট্রিগার ভূমি থেকে তিন-চার ইঞ্চি ওপরে উঠে যায় এবং রেকারটি প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে থাকে। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে, রেকার দুটির লিফটিং ক্যাপাসিটি বা উত্তোলন ক্ষমতা ১০ টনের বেশি হবে না। তিনি জানান, এই রেকার দুটির মূল্য আগের একই সাইজের এবং একই দেশে নির্মিত রেকার চারটির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে আরও রয়েছেন বিআইডব্লিউটিসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) এন এস এম শাহাদাত আলী, প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রহিম তালুকদার, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল গফুর সরকার, উপমহাব্যবস্থাপক মো. কামরুজ্জামান ও সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) মো. গোলাম মাওলা।
বিআইডব্লিউটিসির এক কর্মকর্তা জানান, দুই বছর আগে ১০ টন ক্ষমতাসম্পম্ন চারটি রেকার চীন থেকে আমদানি করা হয়েছিল। সেগুলোর প্রতিটির দাম পড়েছিল পৌনে দুই কোটি টাকা। আমদানি করা এ দুটি রেকার হুবহু একই রকমের।
চিঠির শেষ পর্যায়ে নূরুল হুদা এ কমিটিতে কাজ করতে 'বিব্রত বোধ' করার কথা জানান এবং কমিটি থেকে অব্যাহতি কামনা করেন। এ প্রসঙ্গে নূরুল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে তিনি শুধু বলেন, রেকার পরীক্ষা করে তিনি যা পেয়েছেন, সেটা উল্লেখ করে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন এবং পদত্যাগপত্র দিয়েছেন।
রেকার ক্রয় প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান জ্ঞানরঞ্জন শীল বলেন, 'এ ব্যাপারে ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।'
এ প্রসঙ্গে রেকার সরবরাহকারী মেসার্স বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, রেকারের বিষয়টি টেকনিক্যাল। কমিটিতে যারা নন-টেকনিক্যাল লোক আছেন, তারাই আপত্তি করছেন। কারণ, তারা এসব বুঝতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান এসডিএসকে দিয়ে রেকার দুটির সক্ষমতা পরীক্ষা করানো হয়েছে। রেকারগুলোর লিফটিং ক্যাপাসিটি ৪৬ টন বলে এসডিএস সার্টিফাই করেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন