নিবন্ধিত ৪০ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে স্বস্তি বোধ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিবদমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রায় সব দলকেই কমবেশি খুশি করা গেছে বলে মনে করছেন কমিশন সদস্যরা। প্রায় দুই মাসব্যাপী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শুরুতে শঙ্কায় ছিল ইসি। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার সংলাপ শেষে কমিশন সদস্যরা অনেকটাই সন্তুষ্ট।
অবশ্য নির্বাচন বিশ্নেষকরা বলছেন, এই সংলাপে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধ মিটবে না। এর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চাই সমঝোতা। ইসিকে বহুদূর যেতে হবে। সামনে অনেক কঠিন পথ।
ইসি সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রায় ৫০০ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। যদিও একই ধরনের প্রস্তাবের সংখ্যাই বেশি। নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছে ২৫টির মতো দল। এগুলোর মধ্যে বিএনপিসহ ১১টি দল আবার প্রস্তাব করেছে ম্যাজিস্ট্রেসি (গ্রেফতারি) ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের। অন্য দলগুলো বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় প্রয়োজনে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তার স্বার্থে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে সেনা মোতায়েনের পরামর্শ দিয়েছে। তফসিলের পরে বিদ্যমান সংসদ বহাল রাখার পক্ষে-বিপক্ষেও অনেক দল প্রস্তাব দিয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি, সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ইভিএমের ব্যবহার নিয়েও বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব পাওয়া গেছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোট শরিকদের সংলাপে অংশ নেওয়ার বিষয়ে শঙ্কিত ছিল ইসি। কে. এম. নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার সময় বিএনপিসহ তাদের জোটের শরিকরা সিইসির অতীত কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরে আপত্তি ও আস্থার সংকটের কথা জানায়। কিন্তু সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, কিছুটা হলেও আশাবাদী তারা। অন্যদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বলা সত্ত্বেও সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ বিষয়ে সিইসির ব্যাখ্যায় তারা সন্তুষ্ট।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় পার্টির (জেপি) সঙ্গে সংলাপ শেষে বেরিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদা জানিয়েছেন, ২৪ অক্টোবর সাবেক কমিশন সদস্যদের সঙ্গে সংলাপের পরে তারা কমিশনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। এর আগে ২২ অক্টোবর পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রতিনিধি ও ২৩ অক্টোবর নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।
কমিশনের একজন সদস্য সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সংলাপ শুরুর আগে রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে তাদের মনে অনেক রকম শঙ্কা ছিল। সেই পরিস্থিতির কিছুটা উদ্ভব হলেও তা ভালোভাবেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলে তারা মনে করছেন। বিএনপির সঙ্গে সংলাপের পর সিইসির মন্তব্যকে ঘিরে একটি দলের পক্ষ থেকে অবশ্য সিইসির পদত্যাগ দাবি করা হয়। পরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ শেষে ইসি এখন খোশ মেজাজেই রয়েছে।
ইসি কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, সংলাপের সব প্রস্তাব একত্রিত ও সমন্বিত করে শিগগির বই আকারে ছাপানো হবে। এর পর সব দলের কাছে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, প্রস্তাবের মধ্যে অনেকগুলোরই বাস্তবায়নের ক্ষমতা কমিশনের হাতে নেই। আবার অনেকগুলো কমিশন চাইলে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এসব প্রস্তাব কমিশন সভায় তোলার পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
গত ২৪ আগস্ট সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করে ইসি। গতকাল বিকেলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। নিবন্ধিত ৪০টি দলের সঙ্গেই সংলাপ হয়েছে ইসির।
তবে এই সংলাপে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধ মিটবে না জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ সমকালকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে তফসিলের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া বা না দেওয়া ও সেনা মোতায়েন ইস্যুতে ইসির অবস্থান সুস্পষ্ট করতে হবে। কেননা এসব ইস্যুই আগামী নির্বাচনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তফসিলের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া এ ধরনের ইস্যুতে ইসির আইনগতভাবে করণীয় কিছু নেই- এটা বলে বসে থাকলে চলবে না। এসব বিষয়ে সরকারের কাছে ইসির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে হবে।
নির্বাচনকালীন সরকার: নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা নিয়ে সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর কাছ থেকে পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব পাওয়া গেছে। বিএনপিসহ ১৯টি দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে আটটি দল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে। আবার বেশ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান সংসদের অংশীদারদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। তবে ইসি কর্মকর্তাদের মতে, সরকার ব্যবস্থা কখন কী অবস্থায় থাকবে এটা পুরোপুরি ইসির এখতিয়ারের বাইরে। ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় পার্টি-জেপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক এলডিপিও মনে করে এ বিষয়ে ইসির কিছুই করার নেই।
তফসিলের আগে সংসদের অবস্থান: সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে বিএনপি ও বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ ১৫টি রাজনৈতিক দল। তবে কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়েও কমিশনের তেমন কিছু করার সুযোগ নেই। কমিশন বড়জোর সরকারকে প্রস্তাব দিতে পারে। তবে কমিশন সভায় এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে সবাই অস্বীকৃতি জানান।
হলফনামা বাতিল: উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে প্রার্থীদের আট দফা ব্যক্তিগত তথ্য হলফনামা আকারে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার বিধান চালু হয় ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচন থেকে। এবারের সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষ থেকে এ বিধান বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।
তবে কমিশনের আইন শাখার কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এটি কমিশন তো নয়ই, সরকারের পক্ষেও বাতিল করা সম্ভব নাও হতে পারে। একমাত্র আদালতের নির্দেশ ছাড়া এই বিধান তুলে দেওয়ার সুযোগ কম।
এ ছাড়াও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের পক্ষ থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের সমন্বয়ে জাতীয় পরিষদ গঠন, নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে ইসিকে নির্বাচনকালীন তদারকি সরকারের ভূমিকা পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। জাতীয় পার্টির (মতিন) পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচন এক দিনে না করে প্রতিটি বিভাগে আলাদা দিনে নির্বাচন করে এক দিনে ফলাফল প্রকাশের প্রস্তাব দেওয়া হয়। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ফ্রন্ট দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রাখার বিরোধিতা করে। গণফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংসদীয় আসন আরও ১০০ থেকে ১৫০টি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়।
জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও সিপিবিসহ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব রাখার বিধান চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ছাড়া কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক সইয়ের বিধান তুলে দেওয়া ও 'না' ভোটের বিধান পুনরায় চালুর প্রস্তাব করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন