২০০০ সালের পরের কথা। চট্টগ্রাম মহানগরীর লোকাল বাসগুলোতে তখন মোবাইল ও ঘড়ি চুরি হত বেশি। সেই ছিচকে চুরির সঙ্গে লিপ্ত ছিল মাদক সম্রাট ফারুক। র্যাবের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডে মারা যান তিনি। ঘটনাস্থল থেকে ২টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ওয়ান শুটারগানসহ ২ লাখ পিস ইয়াবা ও বিপুল পরিমাণ ফেন্সিডিল পাওয়া যায় বলে জানায় র্যাব-৭ চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারি পরিচালক মিমতানুর রহমান।
তিনি বলেন, ছিচকে চোর থেকে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারি হয়ে উঠেন ফারুক।
তার মরদেহের পাশে থাকা ব্যাগে কুড়িয়ে পাওয়া আইডিতে তার নাম ফারুক হোসেন লেখা থাকলেও অপরাধ জগতে তাকে বস ফারুক, কালা ফারুক, বাইট্টা ফারুক ও বিচ্ছু ফারুকসহ নানা নামে চিনত।
তার অপরাধ অনুসন্ধানের পর আজ শনিবার সকালে মাদক সম্রাট ফারুকের নানারকম ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে আসার কথা জানান মিমতানুর রহমান। তিনি বলেন, ফারুক কেবল চট্টগ্রামের মাদক ব্যবসার অন্যতম নিয়ন্ত্রক নয়, মিয়ানমার ও ভারত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইন এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করত। র্যাবের তথ্য মতে, গত ১৬ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো গন্ধহীন ১০ হাজার হলুদ ইয়াবার যে চালান পাওয়া যায় সে চালানের মালিক ফারুক। এর আগে ২৩ জুন তার ১৫ লাখ ইয়াবা ধরা পড়ে। এছাড়া মিয়ানমার ও ভারত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইন এবং সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মাদক পাচার করে সে। সূত্র মতে, পটিয়ার ছেলে ফারুক ২০০০ সালের দিকে চট্টগ্রাম নগরে আসে। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ফারুক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি না পেরুতেই তার অপরাধে হাতেখড়ি। সে সময় স্টেশন রোড়ে যাত্রীদের ভিড়ে ছোঁ মেরে হাত ঘড়ি, মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিতো সে। পরে চুরি-ছিনতাই ছেড়ে ফারুক চোরাই পণ্য কেনা-বেচা শুরু করে। তার অধীনে থাকা চোরের দল ঘড়ি, মানিব্যাগ নিয়ে জমা দিত ফারুকের কাছে। ২০০৩ সালের দিকে ফারুক চুরির কারবার ছেড়ে যোগ দেয় রেল স্টেশন ভিত্তিক মাদক সিন্ডিকেটে। সে সময় ফারুকের বন্ধু কালা বাদলের সূত্র ধরে স্টেশনের সিন্ডিকেটে আড্ডা দিতে আসতো মনির। তারাই মনিরকে পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দেয়। লুফে নেয় মনির। এরপর ইউসুফের নেতৃত্বে ফারুক ও মনিরের পরিচালনায় বরিশাল কলোনির মাদক ব্যবসা চলছিল জমজমাট। কিন্তু হঠাৎ ইউসুফকে সরিয়ে দিতে চায় মনির। এতে ফারুক সম্মতি না দিলে দুজনের মধ্যে বিরোধ শুরু। পাল্টাপাল্টি মাদক ¯পটের নিয়ন্ত্রণ নেয় মনির-হোন্ডা বাহার সিন্ডিকেট ও ফারুক-ইউসুফ সিন্ডিকেট।
এরই মধ্যে ফারুকদের হামলায় হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় হোন্ডা বাহারের। পরে দুইপক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আবার মাদক ব্যবসা চালায়। এরপর থেকে চট্টগ্রামের রেল স্টেশন ও বরিশাল কলোনি কেন্দ্রিক ইয়াবা ও মাদক ¯পটগুলোতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফারুক ও ইউসুফ সিন্ডিকেট। তাদের অন্যতম সহযোগি হিসেবে আছে আসলাম, পাভেল, মনির, শরীফ, বিপ্লব, বিলাই মনির, কাশেম, জামাল, পলাশ, রুবেল, সোসাইটি মনির, সুমন ও জাফর প্রমুখ।
এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ফারুক ও ইউসুফের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৮টি করে মামলা। যার সিংহভাগই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। বন্দুকযুদ্ধে ফারুক নিহত হলেও ইউসুফসহ সব সহযোগীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানান সিনিয়র সহকারী পরিচালক মিমতানুর রহমান।
অভিযোগ আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তাদের মাসোহারা দিয়ে আসছিল ফারুক ও ইউসুফ সিন্ডিকেট। যার কারণে অভিযানের খবর আগেই ফাঁস হয়ে যেত। বরিশাল কলোনীতে অভিযানে গেলে পরিত্যক্ত মাদক ছাড়া কেউ গ্রেপ্তার হতো না। এভাবেই বার বার গ্রেপ্তার এড়িয়ে আসছিল তারা। এমনকি হাতকড়া পরানো আসামিকেও ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বরিশাল কলোনীতে।
সদরঘাট থানার ওসি মর্জিনা আক্তার এ ব্যাপারে বলেন, গত ১লা মে বরিশাল কলোনীতে অভিযান চালিয়ে খসরু নামের এক মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে সময় দু‘শ থেকে আড়াইশ লোক পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছুড়ে। এসময় হাতকড়াসহ পালিয়ে যায় খসরু। ওই অভিযানে ১০৫ ইয়াবা, ৯৫ বোতল ফেনসিডিল ও মাদক বিক্রির দুই লাখ ৩১ হাজার টাকা উদ্ধার হয়। ওসি মর্জিনা আক্তার জানান, র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ফারুক নিহত হলেও এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শীর্ষ মাদক কারবারি ইউসুফ। ইউসুফের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় কমপক্ষে ১৮টি মামলা আছে; এছাড়া সীতাকুন্ড থানার একটি মামলায় তার কারাদণ্ড হয়েছে। সিআইডির সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে মাদক ব্যবসার মাধ্যমে ইউসুফ দেড়শ কোটি টাকার মালিক হওয়ার তথ্য দিয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউসুফের সম্পদের পরিমাণ পাঁচশ কোটিরও বেশী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন