রাজধানীর তিন হাসাপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে রাস্তায় মৃতসন্তান প্রসব করা পারভীনের (২৫) দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না কেউই। পারভীনের শারীরিক অবস্থা এখন মোটামুটি ভালো। তিনি মানসিকভাবেও সুস্থ আছেন। তবে পারভীনের শরীরে একটু দুর্বলতা ও রক্তশূন্যতা রয়ে গেছে।
পারভীনের দায়িত্ব এখন কে নেবে তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। ২১ অক্টোবর শনিবার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর আজিমপুরে মাতৃসনদ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইশরাত জাহান তার কার্যালয়ে পারভীনের বিষয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
এ বিষয়ে ডা. ইশরাত জাহান বলেন, `আমি পারভীনকে রিলিজও করে দিয়েছিলাম। ও থাকতে চায় না। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো আত্মীয়-স্বজন খোঁজ নিতে আসেনি। পারভীনের বাবা যশোরে থাকেন, তিনিও খোঁজ নেননি। পারভীন দুটি বিয়ে করেছে, স্বামীদেরও কোনো সন্ধান নেই। আমরা মিরপুরের পলাশ নগরের তার ফুপু ও ফুপার সন্ধান পেয়ে হাসপাতালের অ্যাম্বুমেলেন্সে করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে তাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তবে তারা পারভীনের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে লিখিত বক্তব্য দিয়েছে।'
লিখিত বক্তব্যে ফুপু ও ফুপা বলেন, ‘পারভীন আমাদের শ্বশুরের বোনের মেয়ে। দীর্ঘ ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে ভবঘুরে জীবনযাপন করছে পারভীন। সে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। অনেক আগেই পারভীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। তাই আমরা তার দায়িত্ব নিতে পারব না।
পারভীনের ফুপু ও ফুপা এমন লিখিত বক্তব্য দেওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর লালবাগ থানার শরণাপন্ন হয়।
থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে প্রেরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করে হাসপাতালা কর্তৃপক্ষ। তবে পুলিশ জিডি নেয়নি বলে অভিযোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
মাতৃসনদ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান জিডি করতে চাইলে তা নেয়নি লালবাগ থানা পুলিশ। লালবাগ থানার না নেওয়া জিডির একটি কপি। ছবি : প্রিয়.কম।
জিডির একটি কপি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন ডা. ইশরাত জাহান। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘১৭ অক্টোবর মৃত সন্তান প্রসব করলে পারভীনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে রোগী সুস্থ হওয়ায় তাকে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে তার আত্মীয় স্বজনের নিকট হস্তান্তর করা প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত রোগীর কোনো স্বজন দেখতে আসেনি বা খোঁজ-খবরও নেয়নি। তাই তাকে হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণ ডায়েরি করে পারভীনকে সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।’
তবে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জিডি করতে আসছে বলে আমার জানা নাই। তবে আমি যেটুকু জানি, ওই মেয়েটাকে আমাদের কাছে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। হাসপাতালকে আদালতের মাধ্যমে পারভীনকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এরকম পরিস্থিতিতে পারভীনের কী হবে জানতে চাইলে ডা. ইশরাত জাহান বলেন, ‘পারভীন যেতে চায়। কিন্তু ওর লোক নাই। এখন ছেড়ে দিলে তো পারভীন হারিয়ে যাবে। এরকম পরিস্থিতিতে আমিও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরেছি, আমি কী করব। এ বিষয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দেশনা চেয়েছি, তারা খুব শীঘ্রই একটা নির্দেশনা দিলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত ১৬ অক্টোবর প্রসব ব্যথা উঠলে পারভীন রাত তিনটার দিকে সোহেল নামে এক পথচারীর হাতে-পায়ে ধরে। এ সময় সোহেল নামী ওই ব্যক্তি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজ (মিডফোর্ড) হাসপাতালে স্থানান্তর করে। এরপর মিডফোর্ডও পারভীনকে মাতৃসনদ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করে। কিন্তু সেখানেও তিনি চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালের সামনেই মৃতসন্তান প্রসব করেন।
এ বিষয়টি গণমাধ্যমে জানাজানি হলে কেন উচ্চ আদালত স্বঃপ্রণোদিত হয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এবং তাকে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল করতে বলেছেন আদালত।
আগামী ৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, সমাজকল্যাণ সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এবং আজিমপুর মাতৃসদনের সুপারিন্টেডেন্টকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক আয়াকে বহিষ্কার করেছে মাতৃসনদ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে ডা. ইশরাত জাহান বলেন, ‘ওই আয়াসহ আমরা হাসপাতালের আরও কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। এখানে দালাল চক্রেরও হাত রয়েছে। এগুলো আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন