ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য প্রাক্কলিত বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। অথচ বাজেটের পরিমাণ ৫ কোটি টাকার চেয়ে সামান্য বেশি হলেই এসব কাজ করা সম্ভব। বাজেটে বড় ধরনের গরমিল দেখা দেওয়ায় তা যাচাইয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির তদন্তে উঠে আসে পুকুরচুরির মতো মহাদুর্নীতি। কিন্তু দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মাত্র এক বছরের জন্য তিনজনের ও ছয় মাসের জন্য বাকি একজনের পদোন্নতি স্থগিত করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিএসসিসির প্রশাসক নিযুক্ত থাকা অবস্থায় ৪৫ নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নির্বাহী প্রকৌশলী (অঞ্চল-১) মুন্সি আবুল হাসেম, উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আতিক উল্যাহ মৃধা, মো. পারভেজ রানা ও মো. ফরিদুজ্জামান। এই চারজন প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে তা অনুমোদনের জন্য নথিতে উপস্থাপন করেন। উপস্থাপিত প্রাক্কলন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেয় এবং পরবর্তী প্রক্রিয়ায় কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। এতে মোট খরচ ধরা হয় ৯ কোটি ৯২ লাখ ২০ হাজার ১০৮ টাকা। কিন্তু টাকার পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিষয়টি ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের নজরে আসে। পরে তার নির্দেশে কাজগুলোর প্রাক্কলনের সঠিকতা যাচাইয়ের নিমিত্তে তদন্তে আয়তন ও পরিমাপ সরজমিনে যাচাই করা হয়। এতে প্রতিটি কাজে প্রাক্কলিত ব্যয়ের সঙ্গে যৌক্তিক ব্যয়ের বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। এ ছাড়া তিনটি কাজের গ্রুপ-ক ও খ কাজে দ্বৈততার বিষয় প্রমাণ হয়। তদন্তে উঠে আসে প্রায় ১০ কোটি টাকার কথা উল্লেখ করা হলেও এই কাজ মাত্র ৫ কোটি ১১ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৩ টাকায় করা যেত। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে ৪ কোটি ৮০ লাখ ৪৩ হাজার ৯২৫ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। অথচ গুরুতর দুর্নীতি করেও দোষীরা সামান্য শাস্তি পেয়েছেন। এক বছরের জন্য তিনজনের পদোন্নতি স্থগিত ও অন্য একজনের পদোন্নতি ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অভিযুক্ত আতিকউল্লাহ মৃধা কয়েকমাস আগে মৃত্যুবরণ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক-গ্রুপে কাজের নথির ড্রয়িং অনুযায়ী একটি রাস্তার দৈর্ঘ্য দেখানো হয়েছে ৫৫০ মিটার। বাস্তব পরিমাপ অনুসারে এ রাস্তার দৈর্ঘ্য ৪৫৬ মিটার। প্রাক্কলনে এ অংশের রাস্তা প্রস্থ ১২.০০ মিটার ধরে ৬৬০০ বর্গ মিটার রাস্তা উন্নয়নের প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাস্তব পরিমাপ অনুযায়ী এর পরিমাণ ৪৩৫০ বর্গ মিটার। নকশায় ধূপখোলা মাঠের পশ্চিম পার্শের দৈঘ্য ১০০ মিটার দেখানো হলেও বাস্তব পরিমাপ অনুযায়ী উত্তর পার্শে¦র দৈঘ্য ১৭৫ মিটার। উত্তর ও পূর্ব পার্শ্ব মিলিয়ে ২০০ মিটার দেখানো হলেও বাস্তবে তা ১৮০ মিটার ও পূর্ব পাশের দৈর্ঘ্য ১৬৬ মিটার রয়েছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, পূর্ব পাশের রাস্তা ভালো থাকায় কাজ করার প্রয়োজন নেই বলে প্রতিয়মান হয়। পিটের সেকশন অনুযায়ী ইড়ঃঃড়স ষধুবৎ এ ব্রিক ওয়ার্কের পরিমাণ নকশা ও প্রাক্কলনে ০.৫০ মিটারের জায়গায় ০.৮০ মিটার দেখানো হয়েছে। পিটের গভীরতা ৩ মিটার যুক্তিযুক্ত হলেও গভীরতা প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪.২০ মিটার। প্রাক্কলনে ডইগ-এর পুরুত্বে ০.৪৫ মিটার দেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত ০.৩০ মিটার। বাস্তব পরিমাপ ও প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাক্কলনখানা প্রণয়ন করা হলে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৯৮০৬৯৭৭ টাকার জায়গায় ৩৪২২৫৬৮১ টাকায় করা যেত। অর্থাৎ ১৫৫৮১৩৫১ টাকা বেশি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
খ-কাজের নথির ড্রয়িং অনুযায়ী দেখা যায়, ধূপখোলা মাঠের বিভিন্ন পাশের রাস্তার পরিমাপ নিয়েও ছলচাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এখানে একটি অংশে ৭০ মিটার রাস্তার প্রস্থ বাস্তবে ৩ মিটারের জায়গায় নকশা ও প্রাক্কলনে ৫.৫.-৬.০০ মিটার দেখানো হয়েছে। দয়াগঞ্জ রোড পর্যন্ত একটি রাস্তায় বাস্তব দৈর্ঘ্য ১৬৫ মিটারের জায়গায় ২৫০ মিটার দেখানো হয়েছে। প্রস্থ বাস্তবে ৪.৫০ মিটারের জায়গায় ৯ মিটার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া পাইপের ডায়া, পিটের গভীরতা, ব্রিক ওয়ার্কের চওড়া ইত্যাদি বাস্তবের সঙ্গে অসামঞ্জস্য রয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে মিল রাখলে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৯৯০০১২৯ টাকার জায়গায় ১২১৪৬০১৮ টাকায় করা যেত। এ ছাড়া বিভিন্ন আইটেম ও রেট অনুযায়ী মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৯৬৮৯৬৭২ টাকার জায়গায় ৩৯৯০০১২৯ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ২৭৭৫৪১১১ টাকা বেশি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
অন্য একটি কাজের ক্ষেত্রে প্রাক্কলন ও নকশার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল ছিল না। এখানে একটি রাস্তার বাস্তব দৈর্ঘ্য ২৩১ মিটার। যা নথির ড্রয়িং অনুযায়ী ৩০০ মিটার দেখানো হয়েছে। রাস্তাটির প্রস্থ ৪.৫০-৫.০০ মিটার ধরা হয়েছে যা বাস্তবে হবে ৩.৫০ মিটার। অন্য একটি রাস্তায় ১০০ মিটার দেখানো হলেও বাস্তবে ৮৮ মিটার। প্রাক্কলনে নর্দমার দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার ধরা হলেও বাস্তবে এর পরিমাণ ৩১৯ মিটার। প্রাক্কলনে রাস্তার কিছু অংশে ০.১৫ মিটার বালু ভরাট ধরা হয়েছে। বাস্তবে তার প্রয়োজন নেই। প্রাক্কলনে প্লান্ট মেথোড লেভেলিং কোর্স ধরা হলেও বাস্তবে সরু রাস্তার কারণে সব গলিতে অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। বাস্তবতার নিরিখে প্রাক্কলনখানা প্রণয়ন করলে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৯৫১৩০০২ টাকার জায়গায় ৪৮০৪৪৮৪ টাকায় করা যেত। এ ছাড়া বিভিন্ন আইটেমের পরিমাণ ও রেট অনুযায়ী মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৯৩৫৮১৩৭ টাকার স্থলে ৯৫১৩০০২ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ৪৭০৮৫১৮ টাকা বেশি প্রাক্কলন করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে আসে।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল স্বাক্ষরিত এক অভিযোগ বিবরণীতে এমন ঘটনার সত্যতা নিরূপণ হলেও অভিযুক্তরা আছেন বহাল-তবিয়তে।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ঘটনা তদন্তে দায়িত্বে ছিলেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান। সিটি করপোরেশনের এক নথিতে দেখা যায়, ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল অভিযুক্তদের দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তবে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হলেও তিনিই আবার তাদের স্বল্প মেয়াদে শাস্তির সুপারিশ করেছেন। বাস্তবে এমন ভয়াবহ দুর্নীতির ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে না। এর পরও অভিযুক্তরা তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। একই চিত্র দেখা যায়, অভিযুক্তদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীও। তিনি তাদের লঘু দ-ের বিষয়ে সুপারিশ করেন। আলোচিত এমন ঘটনা ধামাচাপা দিতে যেন উঠেপড়ে লেগেছে সবাই। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
তারা বলছেন, পুকুরচুরির মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটলেও সবাই সম্মিলিতভাবে এমন ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করছেন। নামকাওয়াস্তে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। মূলত ঘটনাকে মাটিচাপা দেওয়ার জন্যই এমন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী (অঞ্চল-১) মুন্সি আবুল হাসেম জানান, তার এক আত্মীয় ইন্তেকাল করেছেন। তাই এখন এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না। পরে যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন।
যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী ফরাজী শাহাবউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে। তবে অনেকবার মোবাইলে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলালের মোবাইলে চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন