প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে কেন্দ্র করে চলমান যে আলোচনা সে প্রসঙ্গে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের এ প্রসিকিউটর বেসরকারি ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের চেয়ারপার্সন।
সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত:
— বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে একটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ ধরণের সঙ্কট দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম?
তুরিন আফরোজ: আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি পদে যারাই আসীন হয়েছেন তাদের সময়ের ভালো-মন্দ সবকিছু মিলিয়েই আমরা অতিক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু গণমাধ্যমে এভাবে বিতর্কিত বিষয় কখনো চলে আসেনি। এ ধরণের সঙ্কট এবারই প্রথম।
— কারণ কী বলে মনে করেন?
তুরিন আফরোজ: একটি কারণ হতে পারে, গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে। বেশিরভাগ মানুষ প্রযুক্তি সংস্পর্শে অবস্থান করছে। কোন খবর এক সেকেন্ডে এদিক থেকে ওদিক চলে যেতে পারছে। আরেকটি কারণ, আমাদের প্রধান বিচারপতি গণমাধ্যমে বেশি পরিচিত অতিকথনের জন্য। তার প্রতিটি বক্তব্যের পরে কাউন্টার বক্তব্য আসছে। কিছু লেখা হলে সেটার বিপরীতে লেখা হচ্ছে। বিভিন্ন করণে তিনি বারবার গণমাধ্যমে আসছেন। জনগণ তার সম্পর্কে জানতে পারছেন। তিনি কথা বললে তার পালটা যুক্তি দিতে অনেকে কথা বলছেন। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিটা প্রকট আকার ধারণ করেছে যা ইতিপূর্বে সেই অর্থে হয়নি। প্রধান বিচারপতি নিয়ে টানাপোড়ন এবারই প্রথম নয়। তবে সেগুলো এত ব্যাপকতা পায়নি।
–দ্বন্দ্ব ও সঙ্কটের প্রকৃত কারণ কী?
তুরিন আফরোজ: আমার কাছে যেটা মনে হয় (এটা নিতান্তই আমার ব্যাখ্যা), মাননীয় প্রধান বিচারপতি তার আসন গ্রহণ করার পর থেকে তার এজলাসে এবং এজলাসের বাইরে, বিভিন্ন সভা, সমিতি, সংগঠনের অনুষ্ঠানে যেয়ে মিডিয়াতে এত বেশি বক্তব্য দিয়েছেন, সে বক্তব্যের কারণে কেউ প্রশংসা করছেন, কেউ সমালোচনা করছেন। অতি প্রশংসা ও অতি সমালোচনার কারণে একটা গোলমাল বেঁধে গেছে। আমার কাছে যেটা মনে হয়, মাননীয় প্রধান বিচারপতির মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। তিনি লম্বা সময় ধরে অসুস্থ। তার শারীরিক অসুস্থতা রয়েছে। শারীরিক অসুস্থতার সাথে কিন্তু মানুষের মানসিক অসুস্থতাও শুরু হয়। আমার মনে হয় দুর্নীতির তদন্তের সাথে তার মানসিক ভারসাম্যহীনতার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা উচিত।
— এমনটা মনে হওয়ার কারণ কী?
তুরিন আফরোজ: কারণ তিনি নানা সময় স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। একই মুখে দু’রকম কথা বলেছেন। যেমন ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে তিনি এক জায়গায় বলেছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। আবার তিনিই বলছেন, সরকারের চাপে তিনি বিব্রত। এখন কোন কথাটিকে আমি সত্য বলে ধরে নেবো? একদিকে তিনি বলছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকা উচিত, অন্যদিকে তিনিই আবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কী কী করা উচিত আর কী কী করা উচিত না সেটা মনে করিয়ে দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় তিনিই হস্তক্ষেপ করছেন। ষোড়শ সংশোধনীতে যে ব্যক্তি বলেছেন, দেশের সংসদ অপরিপক্ব, জনপ্রতিষ্ঠান অকার্যকর; আবার তিনি বলছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর সবচে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী। একবার তিনি বলছেন, চাপে ভয় পান না। আবার বলছেন, চাপে বিব্রত হয়ে তিনি বিদেশ চলে যাচ্ছেন। ফলে ছুটির আবেদনে প্রধান বিচারপতি ছুটির কথা উল্লেখ করলেও, দেশত্যাগের আগে বলেছেন তিনি সুস্থ আছেন। আগে আমরা দেখতাম বিচার বিভাগের সাথে নির্বাহী বিভাগের সমস্যা হচ্ছে। এখন দেখলাম বিচার বিভাগের সাথে সংসদের সমস্যা। খোদ বিচার বিভাগের ভেতরে পাঁচজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাইছেন না। তাদের ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছে। সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে উনাকে কেন্দ্র করে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ রয়েছে, সেটা তো জাতি অবহেলা করতে পারবে না।
— প্রধান বিচারপতি জনসম্মুখে কী ধরণের কথা বলতে পারেন, কী ধরণের কথা বলতে পারেন না– এ নিয়ে কোনো আইন আছে কি না?
তুরিন আফরোজ: না। এ নিয়ে কোন আইন এক বাক্যে নেই। তবে আমরা শুধু লিখিত আইনই তো নয়, কিছু প্রথা মানতে হয় আমাদের। কথা বলার স্বাধীনতা তার রয়েছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি কোন ব্যক্তি নন। এটি একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান থেকে প্রধান বিচারপতি যখন কথা বলেন তখন সেটা হয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিফলন। সেখানটাতে আমরা দেখি উনি সমালোচনা করছেন সেটা তার মত না সবার মত তা কিন্তু জানি না। তার কথা যখন আদালত থেকে লিখিত আকারে আসে, সেটি আইন হয়ে যায়। উনি যা বলবেন তা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার পদের যে ভার, যে সম্মান তা রক্ষা করতে হবে।
— সংবিধানে প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের কোনো উপায় আছে কি না?
তুরিন আফরোজ: হ্যাঁ আছে। শুধু প্রধান বিচারপতি না, যেকোন বিচারপতি যদি পেশাগত অসদাচরণ এবং সংবিধান লঙ্ঘন করেন, তাকে অপসারণের সুযোগ রয়েছে। তবে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি সুন্দরভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছেন।
— কে প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের ক্ষমতা রাখেন?
তুরিন আফরোজ: ১৯৭২ এর সংবিধান অনুযায়ী সংসদ, ১৯৭৮ সালে এসে ফরমান বলে সেটাকে করা হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। আবার ষোড়শ সংশোধনীতে বলা হলো সংসদের হাতে এটা পুনরায় হস্তান্তর করা উচিত। আপিল বিভাগের এক রায়ে সেটি আবার বাতিল করে দেওয়া হলো। এখন রিভিউ হবে। এটা বিচারাধীন একটা বিষয়। ফলে এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের হ্যাঁ অথবা না উত্তর নেই। তবে যা বোঝা যায়, আইনের পথে সর্বশেষ অবস্থানে রাষ্ট্রপতি রয়েছেন। তার হাতেই সেই ক্ষমতা রয়েছে।
— তার মানে সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে বিচারপতিকে অপসারণের কোন সুযোগ এই মুহূর্তে নেই?
তুরিন আফরোজ: না। এমন সুযোগ নেই।
— দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করবে কে?
তুরিন আফরোজ: দুদকে তদন্ত হতে পারে। ফৌজদারি অপরাধ হলে ফৌজদারি তদন্ত হতে পারে।
— প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো এই সময়েই কেন সামনে আসছে?
তুরিন আফরোজ: এই সময়েই ঠিক আসছে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা থেকেই একটু একটু করে আসা শুরু হয়। সবাই ভাবছে ষোড়শ সংশোধনীর জন্যই বোধহয় সরকার একটা কিছু করছে। ওয়ান ইলেভেনের সময় কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। পরে সেটি কী হলো আর জানি না। প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তো কাউকে অপরাধী বলা যায় না। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর একদিন এজলাসে বসে বললেন, ‘আমি নিজেও ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলাম। তাতে কী হয়েছে।’ এই যে বিতর্কের জন্ম দেওয়া। এরপর জানা গেল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সাথে তিনি দেখা করলেন। মামলা চলমান থাকলে এক পক্ষের সাথে দেখা করা যায় না। তিনি নিজে এসব স্বীকারও করলেন। মওদুদ আহমেদ সাহেবের মামলার সময় বললেন, তিনি তাদের কথা শুনে বেঞ্চ পুনর্গঠন করলেন। মীর কাশেমের মামলা নিয়েও অনেক কিছু হলো। তিনি বলেছেন, ‘মীর কাশেমের মামলাতে কে কে টাকা খেয়েছে আমরা সবাই জানি। রায়ে ঘোষণা করে দেব।’ কিন্তু আমরা রায়ে এসবের কিছুই দেখলাম না। এমন অনেক জায়গায় উনি ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছেন। তবে এখন একেবারে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে।
— প্রধান বিচারপতি নিয়োগের আগে এসব তদন্ত করে দেখা উচিত?
তুরিন আফরোজ: রাষ্ট্রের যেকোন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের আগে একটু খোঁজ নেওয়া উচিত। কয়েক জায়গায় আমরা দায়িত্বের স্খলন হতে দেখেছি। আমাদের ট্রাইব্যুনালে প্রথম যে তদন্ত অফিসার ছিলেন, তিনি যে জামায়াতের রোকন এটা পরে বের হয়েছে। ফলে এসব বিষয়ে তদন্ত করে দেখা উচিত। এবং আমরা যারা যুদ্ধাপরাধ তদন্তের সাথে আছি, প্রসিকিউশনের সাথে আছি আমাদের উপরেও নজরদারি করা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতের বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পাবো।
— বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়ার আগেও তো তদন্ত করা উচিত ছিল?
তুরিন আফরোজ: দেখুন, কেউ যখন দুর্নীতি করেন সে তো আর সবাইকে জানিয়ে করেন না। আর্থিক দুর্নীতিগুলো ধরতে সময় লাগে। তবে হ্যাঁ, আরেকটু সচেতন হয়ে এসব বিষয়ে আগেই তদন্ত করা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি।
— প্রধান বিচারপতিকে যারা নিয়োগ দিয়েছিলেন তারা এই দায় এড়াবেন কিভাবে? বা এড়ানোর সুযোগ রয়েছে কি না?
তুরিন আফরোজ: তিনি মোস্ট সিনিয়র বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। যদিও এখানে সিনিয়রিটি প্রশ্ন নয়। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ এটি কোনো পদোন্নতি নয়। এটা একটা নিয়োগ। যোগ্য যে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যায়। কিন্তু সেসময় হয়তো মনে করা হয়েছে সিনিয়রিটি মেইনটেইন করে তাকেই নিয়োগ দেওয়া হবে। যেহেতু ওয়ান ইলেভেনের পরে একজন বিচারক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগ করেছিলেন, সিনহা সাহেব যেহেতু করেননি। এতে মনে হয়েছে হয়তো তিনি দুর্নীতি করেননি। তবে এত গা ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। এখন থেকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার আগে শক্ত তদন্ত করা উচিত।
পাঠক মন্তব্য
I do not know which Inn you got your Bar-at-Law from , but they should be ashamed they gave you the certificate. You do not have any qualification to be a member of the Bar...
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন