রহিমা আক্তার সোনিয়া, স্কুলছাত্রী। পঞ্চগড়ের এই মেয়েকে ওষুধ দেয়ার কথা বলে একটি বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। সেই ধর্ষণের ভিডিও ধারণও করা হয়। এরপর সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাকে দফায় দফায় ধর্ষণ করতে থাকেন ধর্ষকেরা। এক পর্যায়ে ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে।
জাকিয়া সুলতানা রূপা, কলেজছাত্রী। সিরাজগঞ্জের মেয়ে। বাসে করে বাড়ি যাচ্ছিলেন। এসময় চলন্তবাসে তাকে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। দেশব্যাপী আলোচিত এ ঘটনার পর ধর্ষকদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে উঠে। যা অন্য ধর্ষণের ঘটনায় দেখা যায় না।
শুধু সোনিয়া বা রূপার বেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে তা নয়। প্রায় দিনই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এসবের অনেক ঘটনায় মামলায় হচ্ছে। আবার অনেক পদ্মার আড়ালে থেকে যাচ্ছে। সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে ধর্ষিতার পরিবার ঘটনাটি চেপে যাচ্ছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে যে দিনকে দিন ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে। সংস্থাটির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ৯ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৭০ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৭২ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে। আর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়ে ১৫২ জনকে।
গত বছর অর্থ্যাৎ ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৮৪০ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৬৬ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল ৪৪ জনকে। আর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল ১৬৫ জনকে।
গত বছর অর্থ্যাৎ ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৮০৮ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৯৯ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল ৮৫ জনকে। আর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল ১৪২ জনকে।
সোনিয়া
পঞ্চগড়ের কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল ও কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী সোনিয়া। তিন মাস আগে মা সেলিনা বেগমের চিকিৎসার জন্য ওষুধ দেয়ার কথা বলে তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে ধর্ষকেরা।
এ ঘটনার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সোনিয়া আত্নহত্যা করে। এ ঘটনায় সোনিয়ার বাবা বাবা জাহিরুল ইসলাম ১১ অক্টোবর (বুধবার) রাতে ধর্ষণ এবং আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে রাজন ও আতিকের নামে তেঁতুলিয়া থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু পুলিশ অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ডের কথা বলে মামলা রেকর্ড করেনি বলে জাহিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, এতো বড় অন্যায়ের বিচারটাও কি পাবো না?
রূপা
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামে বাড়ি রূপার। তিনি বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে ঢাকা আইডিয়াল ল’ কলেজে এলএলবি শেষ পর্বে পড়াশোনা করছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তিনি। তার কর্মস্থল ছিল শেরপুর জেলা।
২৫ আগস্ট (শুক্রবার) রুপা বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য সন্ধ্যা সাতটার দিকে ছোঁয়া পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। রাত ১০টার দিকে ওই চলন্ত বাসে তাকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। এরপর তার লাশ টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে ফেলে রেখে যায়।
তনু
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকেও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হয়। কিন্তু সেই ঘটনার প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতো দিনেও বিচার না পেয়ে বিচারের আশাটাও ছেড়ে দিয়েছে তনুর পরিবার।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তনুর মা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমি গরিব দেখে সরকার আমার মেয়ে হত্যার বিচারটা করতে পারলো না। সরকারের কাছে আমার আবেদন মেয়ে হত্যার বিচার যেন হয়।
কেন ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে?কেনইবা তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? এ ব্যাপারে এ প্রতিবেদক কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সাথে। তারা বলেছেন, সামাজিক অস্থিরতা এবং মূল্যবোধের কারণে এসব অপরাধমূলক কাজ বেশি হচ্ছে। আবার আইনের ফাঁক ফোকড় দিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
তাই আইনের পরিবর্তন করে ধর্ষকের সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে নির্যাতিত এসব মানুষের পাশে দাড়াতে হবে রাষ্ট্রকেই বলে মনে করেন ওইসব বিষেজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, সাম্প্রতি সময়ে আমাদের মূল্যবোধের প্রচণ্ড অভাব হয়েছে। এ কারণে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি দাবি করেন বিচার প্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে অপরাধীদের সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তাই অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে অনেকেই। যার ফলে ধর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি মনে করেন এ থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। এগুলো পরিবার থেকে, স্কুল থেকে শুরু করতে হবে। ছোট বেলা থেকেই বাচ্চাদের শেখাতে হবে। অপরাধ করা উচিৎ না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, যৌন নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধে কিশোরী ও তরুণীদের সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সহপাঠীদের সাথে দলবদ্ধভাবে স্কুল কলেজে যাতায়াত করাসহ পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে হবে। সেই সাথে পরিবার ও সমাজকে নির্যাতনের শিকার কিশোরী ও তরুণীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সকলে মিলে মিলিতভাবে যৌন নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এছাড়াও যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের আলোকে পৃথক আইন তৈরিসহ রায়ের বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যও দাবি জানিয়ছেন মালেকা বানু।
এ প্রসঙ্গে জানাতে চাইলে অাইনজীবী সালমা ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, সবচেয়ে বড় যে সমস্য তৈরি হয়েছে সেটা হল অপরাধের বিচার নেই। আইনের প্রয়োগ একদমই দেখতে পাচ্ছি না। এ কারণে অপরাধীরা দেখছে অপরাধ করলে তো কোনো সাজা হচ্ছে না। তাই দিন দিন এ ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় সামনে ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন