একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচনী অংশীজনদের সঙ্গে বিভিন্ন ধাপে সংলাপ সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রায় তিন মাস ব্যাপী ধারাবাহিকভাবে সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, পর্যবেক্ষক, নারী নেত্রী, নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ শেষ করল নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
নির্বাচনী অংশজনদের কাছ থেকে সংলাপে ইসির কাছে সবমিলিয়ে প্রায় ৬ শতাধিক সুপারিশ এসেছে। যদিও সংলাপে আলোচনার জন্য ঘোষিত নির্বাচনী রোডম্যাপ অনুযায়ী সাতটি বিষয় নির্ধারণ করে দিয়েছিল ইসি। কিন্তু এর বাইরেও আরও অনেক বিষয়ে প্রস্তাব রেখেছেন অংশীজনরা। একদিকে যেমন ইসির এখতিয়ারধীন প্রস্তাব এসেছে, একইভাবে এখতিয়ারবহির্ভূত অনেকগুলো বিষয়েও প্রস্তাব এসেছে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি ইস্যুতে বিপরীতমুখী প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে কমিশনকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করাই এখন ইসির মূল চ্যালেঞ্জ। এসব প্রস্তাবের যথাযথ বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। দেখার বিষয় প্রস্তাবগুলো এখন কিভাবে যাচাই বাছাই করা হয়, কী সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।
সংলাপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। সংলাপে অংশ নেয়া নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টিই সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে। ১৯টি দল নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে বলেছে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছে দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে। তবে ৮টি দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে।
সীমানা পুননির্ধারণ, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ, নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ বহাল বা ভেঙে দেওয়া এবং সেনা মোতায়েন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো বিপরীতমুখী প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মূল প্রস্তাবগুলো পরস্পরবিরোধী। বিশেষ করে সেনা মোতায়েন, সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে দুদলের অবস্থানওে বিপরীতমুখী। নির্বাচনকালীন সরকার ও সংসদ বহাল রাখা না-রাখা নিয়ে আওয়ামী লীগ ইসিতে কোনও আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব না দিলেও এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের অবস্থান যে বিএনপির বিপরীতে- সেটি স্পষ্ট।
এছাড়া সংলাপে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে- সকল দল ও প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দেয়া, সকলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা, নির্বাচনের সময় সকল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়কে কমিশনের অধীনস্ত করা, নির্বাচনের আগে ও পরে সন্ত্রাস দমনের ব্যবস্থা করা, একই মঞ্চে নির্বাচনী প্রচারণার ব্যবস্থা করা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করা, নিবন্ধিত দলগুলোর পরামর্শ নিয়ে একটি জাতীয় ফোরাম গঠন, সেনাবাহিনী মোতায়েন ও ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে প্রস্তাবকারী দলগুলোর প্রস্তাব যাচাই বাছাই করা, সীমানা নির্ধারণ করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেয়া, না ভোটের বিধান চালু করা, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া, সকল আইন বাংলায় করা ও সংরক্ষিত নারী আসন বৃদ্ধি করা।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফয়েল আহম্মেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি ব্রেকিংনিউজকে বলেন, “প্রস্তাবগুলো কমিশনের টেবিলে রাখা হয়েছে। এখন দেখা যাক তারা কী করে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসি নির্ধারিত ৭টি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।”
নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ ইসির এখতিয়ারবহির্ভূত বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাব নিয়ে ইসি কী করবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত ৭টি বিষয়ের মধ্যে কী সীমাবদ্ধ ইসি? না কি তারা (ইসি) সরকারেরও কিছু পদক্ষেপ চায়।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক সমস্যা যেগুলো রয়েছে তা কমিশন একা সমাধান করতে পারবেন না। এগুলো রাজনীতিবিদদের নিয়ে একসঙ্গে সমাধান করতে হবে। কমিশন সেই ব্যবস্থাটার কথা তাদের বলবেন। বলবেন এটা আমাদের করণীয় নয়, এটা আপনাদের (রাজনীতিবিদ) দায়িত্ব। এখন দেখতে হবে কমিশন কী করে, তারা কিভাবে সামনের দিকে চলে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ ব্যাপারে ব্রেকিংনিউজকে বলেন, “নির্বাচন কমিশন ধারাবাহিকভাবে যে সংলাপ করছে তা বলা চলে আশার দিক। তবে শুধু সংলাপ করলে হবে না, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংলাপে আসা সুপারিশগুলো বিবেচনায় আনতে হবে।”
তিনি বলেন, “সংলাপের মধ্য দিয়ে যে সুপারিশ আসবে, সেগুলো তারা বিবেচনা করবে। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে আইনকানুন ও বিধিবিধানে যে ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার, সেগুলো তারা করবে। তাহলেই সংলাপ সফল হবে।”
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাজিফ উদ্দিন খান বলেন, “বেশকিছু শঙ্কা থাকলেও আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আমি মনে করি। ইসির সংলাপে যে সকল প্রস্তাব এসেছে সেগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় তবে আগামী নির্বাচন গণন্ত্রণের জন্য আশার আলো দেখাবে।”
এছাড়া নির্বাচন কমিশন যেসব কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তাতে অনেকটাই আশার আলো দেখছেন এই বিশেষজ্ঞ।
এদিকে সংলাপে উঠে আশা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে কমিশন। আগামী বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) বেলা ১১টায় নির্বাচন কমিশন ভবনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, “সংলাপ শেষে সুপারিশগুলো একীভূত করা হবে। যেসব সুপারিশ ইসির এখতিয়ারের মধ্যে থাকবে এবং অভিন্ন হবে-তা কমিশন একীভূত করবে। সেই সঙ্গে যেসব সুপারিশ এখতিয়ারের বাইরে রয়েছে সেগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধান করে একীভূত করা হবে। সার্বিক সুপারিশ কমিশনের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে।”
ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাও বলেছেন, ‘সংলাপ শেষে সবার প্রস্তাব একীভূত করে আমরা একটি প্রতিবেদন করবো। আমাদের করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বসবো। যেসব বিষয় আমাদের এখতিয়ারে নেই সেগুলোর বিষয়গুলো প্রয়োজনে সরকারের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।’
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন