বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিনদেশি মুরব্বিদের প্রভাব সবসময়ই ছিল। এটা কখনো স্বীকার করা হয়, কখনো স্বীকার করা হয় না। মুরব্বিদের মধ্যেও থাকে প্রতিযোগিতা। সবসময় সবার সমান প্রভাব থাকে না। ৫ই জানুয়ারির আগে যেমন পশ্চিমা অতিথিরা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধে ভারত।
একতরফা নির্বাচনের পক্ষে সে সময় ভারতের অবস্থান ছিল একেবারেই স্পষ্ট। ঢাকায় নিযুক্ত তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দিল্লি গিয়েও ভারতের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হতে এক বছরের কিছু বেশি সময় বাকি। তবে এরইমধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক নড়াচড়া শুরু হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সেভাবে উচ্চারিত না হলেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সদ্য সমাপ্ত সফরেও আগামী নির্বাচন নিয়ে সবপক্ষের সঙ্গেই আলোচনা হয়েছে । ঢাকার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে সুষমা স্বরাজের দুটি বার্তা অনেকটাই স্পষ্ট। ১. ভারত বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। ২. নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা এদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে। তবে অন্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও তেমন হলে ভারতের কোন আপত্তি নেই।
অনেক পর্যবেক্ষকই ভারতের অবস্থানে কিছুটা নতুনত্ব পেয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সুষমা স্বরাজ প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। দ্বিতীয়ত, ভারতের অবস্থানে খুব বড় কোনো পরিবর্তনও হয়নি। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংহের বাংলাদেশ সফরের কথা স্মরণ করেন। ওই সফরের সময় তিনি একতরফা নির্বাচনের পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। এমনকি সেসময় জাতীয় পার্টিকেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য তিনি চাপ দেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে সুজাতা সিং তাকে বলেছিলেন, তাহলে তো জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় আসবে। সেসময় ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হওয়া জরুরি। এটি অবশ্যই স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ হতে হবে। সেটি সব দলের অংশগ্রহণে হবে না অধিক সংখ্যক দলের অংশগ্রহণে হবে তা বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে চলেছে এটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। যে কারণে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সবপক্ষের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। অন্যদিকে, দলগুলোও চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর আনুকূল্য পেতে। সুষমার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি উৎফুল্ল না হলেও দলটির মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে। কংগ্রেসের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব যতটা ছিলো বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তা কিছুটা কমে এসেছে। বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে বিএনপির একটি অংশের একধরনের যোগাযোগও গড়ে ওঠেছে। দলটির অনেক নেতাই মনে করেন, ভারত সরকারের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক সাম্প্রতিক অতীতের মধ্যে একটি ভালো অবস্থানে উপনীত হয়েছে।
এই যখন অবস্থা তখন প্রশ্ন উঠছে, কেমন হবে আগামী নির্বাচন। কোনো রূপরেখা তৈরি হচ্ছে? জামায়াত এরইমধ্যে অনেকটা মৃত। জাতীয় পার্টি এখন ভূমিকাহীন। লড়াই মূলত আওয়ামী লীগ-বিএনপির। যদিও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে ঘরের লড়াইও মোকাবিলা করতে হবে আওয়ামী লীগকে। বিএনপি হয়তো সহসাই সহায়ক সরকারের ফর্মুলা হাজির করবে। কিন্তু সে দাবি আদায়ের ক্ষমতা দলটির আছে বলে খুব বেশি মানুষ বিশ্বাস করেন না। তবে ন্যূনতম সমঝোতার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমঝোতার কোনো ইতিহাস নেই। মুরব্বিদের ভূমিকা কী হয় তাই হবে দেখার।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত কতটা গুরুত্বপূর্ণ
এদিকে, বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গ টানেন। একটা ধারণা প্রচলিত আছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একতরফা সে নির্বাচনে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়েও বাংলাদেশের ভেতরে সমালোচনা রয়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধীরা মনে করেন, গত আট বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপকভাবে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। এবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যখন দু’দিনের সফরে ঢাকা আসলেন, তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে এনিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি’র একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সে বৈঠক শেষে বিএনপি’র তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে ভারত বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন দেখতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল- বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র কাছে ভারত আসলেই কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক আছে আওয়ামী লীগের। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদলে ভারতের ভূমিকা নিয়ে যেসব আলোচনা আছে সেগুলোকে কিভাবে দেখে আওয়ামী লীগ? এমন প্রশ্নে মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কখনোই এটা মনে করে না। আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সবসময়ই জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। জনগণ যার পক্ষে থাকবে তারাই জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে। জনসমর্থন যাদের নেই তারাই সবসময় বহির্বিশ্বের কাছে ধরনা দেয় এবং পরনির্ভরশীলতা দেখায়। আওয়ামী লীগ কখনো পরনির্ভরশীলতা দেখানো প্রয়োজন মনে করে না।’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা যে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই সেটি বোঝা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে। মাস ছয়েক আগে তিনি কয়েকবার মন্তব্য করেছিলেন যে, ২০০১ সালে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির প্রতিজ্ঞা করে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। এবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকের সময় বিএনপি নেতারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সে প্রতিনিধি দলে ছিলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিএনপির কাছে ভারত কতটা গুরুত্বপূর্ণ? মি. হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে ভারতের সঙ্গে যে সম্পর্ক সেটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। অতএব আমরা মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতি, উন্নয়ন, সামাজিক বিষয় সবকিছু ভারতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আমি কোনোভাবেই মানতে রাজি নই যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কোন আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করে।
বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের কাছে ভারতের গুরুত্ব কতটা সেটা খোলামেলাভাবে না বললেও বিশ্লেষকরা মনে করেন এটি নিয়ে এখন আর কোনো রাখঢাক নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করবে। কারণ আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাবনিকাশ সেটিই ইঙ্গিত করছে বলে তাদের ধারণা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন