১. দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকা রংপুরের হিন্দু বাড়িগুলোর দিকে তাকানো যায় না। আহাজারি করে ক্রন্দনরত নারীর ছবিটার দিকে আপনি কতক্ষণ চোখ রাখতে পারছেন, পারছেন কি?
পারার কথা না।
আমি পারিনি। কতবার যে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়েছি। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছি। পারিনি। বারবারই ছবিগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। সেখানে ভেসে ওঠেছে বাংলাদেশের মানচিত্র। মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানচিত্রজুড়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। মনে হয়েছে, বাংলাদেশ আহাজারি করে কাঁদছে।
আসলে কি বাংলাদেশ কাঁদছে? আসলে কি বাংলাদেশ এখন কাঁদে? হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগলে, হিন্দু নারী নির্যাতিত হলে বাংলাদেশ কি সত্যিই এখন কাঁদে।
হিন্দুই বলি কেন? নাগরিকের যন্ত্রণা কি এখন বাংলাদেশকে স্পর্শ করে? স্পর্শ করলে রংপুরের ঘটনা কিভাবে ঘটে?
২. উত্তেজনাটা চলছিল কয়েক দিন ধরেই। তাহলে রংপুরের প্রশাসন কি করেছে? রাজনৈতিক দলগুলো কি করেছে? সাংস্কৃতিক কর্মীরা কি করেছেন? স্মৃতি বলি, কিংবা অভিজ্ঞতা বলি, নাসিরনগরের দৃষ্টান্ত তো আমাদের সামনে ছিলোই। তা হলে? নাসিরনগরের ঘটনাও ঘটেছিলো ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। এবারও ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করেই যখন উত্তেজনা, তখন কারও মনেই নাসিরনগরের স্মৃতি হানা দেয়নি? দেয়নি- এ কথা কিভাবে বিশ্বাস করি? তাহলে আমরা সবাই মিলেই কি ঘটনা ঘটতে দিয়েছি?
৩. চিকিৎসক, শিল্পী গুলজার হোসেন উজ্জ্বল ফেসবুকে নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন, “বাংলাদেশ যে একটা মুসলিম অধ্যুষিত বার্মা (মিয়ানমার) সেটা আমরা স্বীকার করব না। স্বীকার করলেই ব্যপারটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। বার্মা যেটা আর্মি দিয়ে করায় আমরা নিজেরাই সেটা করি। আস্তে আস্তে থেমে থেমে। তবে এটা স্বীকার করা যাবে না। স্বীকার করলেই আমাদের মাহাত্ম্য শেষ।
সমস্ত মানব জাতির ভেতরই একখণ্ড বার্মা বাস করে। এবং সকল সংখ্যালঘুই হয় এক একজন রোহিঙ্গা। পোড়া ঘরের ছবিও একই রকম। আহাজারি করা মানুষের চেহারাও প্রায় এক। তাই একই ছবি আপনি চাইলে রোহিঙ্গা, ইয়েমেনি, রংপুরের হিন্দু সবার ক্ষেত্রেই ব্যাবহার করতে পারবেন। শুধু স্বীকার করবেন না। কেউ কিছু বললে ত্যানা প্যাঁচাবেন। ”
৪. সংখ্যালঘু শব্দটা আসলে কি? এর অর্থ কি? সংখ্যালঘু কি সীমান্ত ভেদে ভিন্ন হয়ে যায় না? সীমান্তের এই পাড়ে যারা সংখ্যালঘু, তারাই কি সীমান্ত পেরোলে সংখ্যাগুরু হয়ে যায় না? বাংলাদেশে যেই মুসলমানরা সংখ্যাগুরু, ভিন্ন সীমান্তে তারাই কি সংখ্যালঘু না? কানাডাতে, পশ্চিমের দেশগুলোতে মুসলমানদের নিয়ে কেউ কোনো কথা বললেই আমরা বলতে শুরু করি- ‘ইসলামোফোবিয়া’। দেশের সরকার, প্রশাসনও ‘ইসলামোফোবিয়া’র বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। কানাডার কোনো কোনো প্রদেশে তো ‘ইসলামোফোবিয়া’র বিরুদ্ধে আইন পর্যন্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে যা হচ্ছে, সেটি কি তবে ‘হিন্দুফোবিয়া’?
৫. ফেসবুকে কে কি লিখলো তাতেই কি ধর্মের অবমাননা হয়ে যায়? ধর্ম কি এতটাই ঠুনকো? বিশ্বাসীরা তো বিশ্বাসই করেন- ধর্ম এসেছে স্রষ্টার কাছ থেকে, মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, মনে প্রাণে মানেন- ধর্ম হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধান। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার দেওয়া বিধান কি তাঁর সৃষ্টির আচরণে হেয় হয়ে যায়? যেতে পারে? আর স্বয়ং আল্লাহ যে ধর্ম পাঠিয়েছেন, সেই ধর্ম কি তাঁর অবমাননার শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব ‘সৃষ্টি’কে দিয়েছে? তা হলে?
বিশ্বাসীরা বলেন, ধর্ম হচ্ছে কল্যাণের পথে মানুষকে ডাকার একটি পথ। তাই যদি হয়, সেই ধর্ম নিশ্চয়ই কারো বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়াকে সমর্থন করে না। ধর্মের নামে মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না! ধর্ম নিয়ে যারা কাজ করেন, যারা ধর্মীয় নেতা- তারা কি কখনো সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়েছেন- এইসব বর্বরতার বিরুদ্ধে? নাসিরনগরের ঘটনার পর দেশের ওলামারা কি সম্মিলিতভাবে বলেছেন, ইসলামের নামে এইসব বন্ধ করো। রংপুরের ঘটনার পর কি তারা সমস্বরে বলবেন, ইসলামের নামে এই ধরনের সহিংসতা বন্ধ করো।
৬. কানাডায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু। বিভিন্ন সময় দেখেছি, রাতের অন্ধকারে ভেঙে দেওয়া মসজিদের পুনঃনির্মাণের দায়িত্ব নিচ্ছে খ্রিস্টানদের চার্চ। ‘ফার রাইটিস্ট গ্রুপ’গুলো যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো সভা ডাকে, সেখানে সংখ্যায় তাদের চেয়ে বেশি সংখ্যক ভিন্নধর্মাবলম্বীরা মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। তারা তো বলে না মুসলমানের পাশে আমি দাঁড়াবো না। বাংলাদেশেও প্রতিটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মুসলমানরাই পাশে দাঁড়ান। যারা পাশে দাঁড়ান তাদের সিংহভাগই নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়েও মানুষ হিসেবেই বেশি ভাবেন। রংপুরের ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে সেই মানুষরা কোথায় ছিলেন?
লেখক: টরন্টোর বাংলা পত্রিকা 'নতুনদেশ'- এর প্রধান সম্পাদক
বিডি-প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন