জন্ম থেকেই দুই পা নেই। হাটি হাটি পা পা করে তার কোথাও যাওয়া হয়নি।
বাবা-মাকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়েই তার জন্ম। দুই হাতই তার পা। এই দুই হাতের উপর ভর করেই খেলাধুলা। একটু বড় হলেই অন্যদের স্কুলে যেতে দেখলে স্কুলে যাবার সখ জাগতো তার। কিন্তু পরিবারের ভয় এই ছেলে কি করে স্কুলে যাবে এর তো পা নেই। শিশু দ্বীন মোহাম্মদ নিজের জেদ আর আগ্রহেই স্কুলে ভর্তি হয়। একটু একটু করে লেখাপড়া করতে শুরু করে। প্রাইমারী স্কুল শেষ করে এবার সে জেএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
নড়াইল সদরের বাশগ্রাম এলাকার প্রান্তিক কৃষক আলী বুড়া ও লাকি বেগমের ৩ ছেলে-মেয়ের দ্বিতীয় সন্তান ১৩ বছরের দ্বীন মোহাম্মদ।
বাশগ্রাম বিষ্ণুপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাতে(জেএসসি) সে এবার অংশ নিয়ে চাঁচুড়ি-পুরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছে।
যেদিন দ্বীন মোহাম্মদের জন্ম, সেদিন পরিবারের কারও মুখে হাসি ফোটেনি। তাঁকে একনজর দেখতে আসা প্রতিবেশীরাও মন খারাপ করে চলে যান। এমন ছেলে জন্ম দেওয়ায় দ্বীন মোহাম্মাদের মাকে আত্মীয়-স্বজনরা কম অপবাদ দেইনি। সবাই বাকা চোখে তাকিয়েছে যেন এই ছেলে জন্ম দেবায় সব দোষ তাঁর। সংসারের প্রথম ছেলের দুটি পা ছাড়া জন্ম নেওয়ায় খুবই কষ্ট পান তিনি। তবে দ্বীন মোহাম্মাদ থেমে থাকেনি। জন্ম থেকেই সে দুই হাতের উপর ভর করে নিজের মনের জোরে অনেক দ্রুতবেগে চলাচল করে। এমনকি প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সে বাশগ্রাম বিষ্ণুপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আসে। নিয়মিত ক্লাস করার পাশাপাশি দুটি বিষয়ে প্রাইভেটও পড়ে। হাত দিয়ে হেটে চলাফেরা করতে অনেক কষ্ট হলেও সে মেনে নিয়েছে তার নিয়তি। অন্যান্য ছেলেদের মতো হাতকে পুজি করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে চায় সে। পড়াশুনার পাশাপাশি সে ঘরের কাজে তার মাকেও সাহায্য করে। বাজারে যায়, এটা ওটা কেনাকাটা করে।
দ্বীন মোহাম্মদের সহপাঠী ইলিয়াস, মামুন জানান, আমাদের মতো সুস্থ্য ছেলেদের চেয়ে ওর লেখাপড়ার ইচ্ছা অনেক বেশী। আমরা ওকে স্বাভাবিক অন্য বন্ধুদের মতোই দেখি, ওর সাথে ইয়ার্কি-দুষ্টুমি করি। ও খুব ভালো মনের ছেলে।
দ্বীন মোহাম্মাদের মা লাকি বেগম বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হলেও আমার ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করছি। বড় হয়ে তার যেনো কারো কাছে হাত পাতা না লাগে, সে কারণে তাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি। পড়ালেখায় তার খুব আগ্রহ। যতদূর পারি তাকে পড়ালেখা করাব। ফাইভে (পিএসসি) সে “এ” গ্রেড (জিপিএ ৪.০০) পেয়েছিলো। আশা করি অষ্টম শ্রেণিতেও (জেএসসি) ভালো রেজাল্ট করবে।
বাশগ্রাম বিষ্ণুপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু সাঈদ শিকদার জানান, ছেলেটি লেখাপড়ায় খুবই মনযোগী। আমরা তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করে থাকি। প্রতিবন্ধীদের বিনা খরচে পাঠদানের কথা রয়েছে। আমরা তার কাছ থেকে বেতন-ভাতা নেই না। তবে শুধুমাত্র পরীক্ষার ফি নেওয়া হয়। আমরা পরবর্তী থেকে তাকে সম্পূর্ণ বিনা টাকায় লেখাপড়ার ব্যবস্থা করব।
শিশু দ্বীন মোহাম্মাদ জানান, ‘আমার লেখাপড়া চালানোর জন্য অনেকের সহযোগিতা রয়েছে। আমার সহপাঠীরা এবং স্কুলের শিক্ষকরা আমার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। তবে স্কুলের বেতন-ভাতা ফ্রি হলে আমার জন্য আরো সহজ হতো। ’
সে আরো জানায়, 'আমি লেখাপড়া করে একদিন বড় ব্যাংকার হতে চাই। পা নেই তাতে কি হয়েছে?লেখাপড়া করেই আমি প্রতিষ্ঠিত হবো,পরীক্ষায় ভালো ফল করে মা-বাবার মুখ উজ্জল করব। বাবা-মায়ের কষ্টের প্রতিদান দিতে চাই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন