ভৈরব-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের বেহালের চিত্র। ছবি : এনটিভি
কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাজার থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় যাচ্ছিলেন কয়েকজন যাত্রী। রাস্তাটি খানাখন্দে ভরা। একটু পর পরই ঝাঁকুনি। বার বারই শোনা যাচ্ছিল উহঁ! আহ! শব্দ।
শব্দগুলো করছিলেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। অটোরিকশাটি চলতে চলতে হঠাৎ কাঁত হয়ে পড়তে পড়তেও দাঁড়িয়ে যায়। ওই ভদ্রলোক হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘বাবারে মাজাটা আমার ভাইঙ্গাই গ্যাল।’
পাশে বসা অন্যজন একটু হেসে বলে উঠলেন, ‘এডা মাজাভাঙ্গা মহাসড়ক ভাই।’ এদের সঙ্গে যোগ দিলেন অন্য আরেকজন, ‘এই রাস্তা দিয়া সরকার ভৈরবের মাইনষের মাজা ও হাড়গোড় ভাঙ্গার প্রকল্প হাতে নিছে ভাই।’
যে মহাসড়কের কথা বলছি এটি ভৈরব-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের ভৈরবের সড়ক। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ভৈরব বাসস্ট্যান্ডের দুর্জয়মোড় থেকে ভৈরব হাজি আসমত কলেজ অংশ পর্যন্ত রাস্তাটি বেহাল হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। দেখার কেউ নেই। সড়কটির প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত রাস্তার প্রায় পুরোটাই যানবাহন চলাচলের অনুপোযোগী। রাস্তাটির জায়গায় জায়গায় গর্ত হওয়ায় বিভিন্ন যান চলাচল করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই এই পথে চলতে গিয়ে যাত্রীরা আহত হচ্ছে।
ভৈরব বাস মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক জালাল আহমেদ বলেন, সড়কটি আঞ্চলিক সড়ক হলেও এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সড়ক দিয়ে ঢাকা-ভৈরব-কিশোরগঞ্জ, ভৈরব-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ, সিলেট-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-ভৈরব-ময়মনসিংহ-বগুড়াসহ অনেক এলাকার শত শত যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন যাতায়াত করে। সড়কটির এই বেহালদশায় যাত্রীরা যেমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তেমনি পরিবহন মালিকরাও লোকসানের মধ্যে পড়ছেন। সড়কের সৃষ্টি গর্তের কারণে যানবাহনের যন্ত্রাংশ প্রায়ই বিকল হয়ে যায়। যাত্রীরা এই সড়কের বিকল্প হিসেবে ট্রেন বা অন্য পথ বেছে নিচ্ছেন। তিনি রাস্তাটি দ্রুত মেরামতের দাবি করেন।
এই পথের যাত্রীরা জানান উৎকণ্ঠার কথা। ব্যবসার কাজে ওই বেহাল সড়ক দিয়ে নিয়মিত যাতায়াতকারী মাসুদ কামরান বলেন, তিনি নিয়মিত কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে যাতায়াত করেন। এইটুকু পথ পাড়ি দেওয়ার সময় ভয় আর আতঙ্কে থাকেন তিনি।
যাত্রী অঞ্জলি রানী বলেন, তিনি ভৈরব থাকেন। কুলিয়ারচরের একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। প্রতিদিন ভৈরব থেকে কুলিয়ারচরে যেতে হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে তিনি যাতায়াত করেন। তাঁর ভাষায়, ‘ভগবানকে ডাকতে ডাকতে এইটুকু পথ পাড়ি দেই।’ তিনি আরো বলেন, এক বছর ধরে এই পথে চলতে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা হয়। এ কারণে নিয়মিত ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে হয় তাঁকে।
শুধু যাত্রী নয়। চরম ভোগান্তিতে আছেন এই সড়কের দুই পাশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও। গত ৪ নভেম্বর এই সড়কের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অফিসের বিপরীত থেকে এক ব্যবসায়ী তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ওয়ালে লিখেন, ‘দুর্জয় মোড় থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত রাস্তাটি দেখার কেউ নেই, হায়রে অভাগা ভৈরব! সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও নেতা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ তাঁর এই স্ট্যাটাসে ৪৩ জন মন্তব্য প্রকাশ করেন। যাদের বেশির ভাগই স্থানীয় সংসদ সদস্য, পৌরসভার মেয়র ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের তীব্র সমালোচনা করেন।
এদিকে সড়কটির দীর্ঘদিনের বেহালদশা ও জনভোগান্তির বিষয়টি ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিলরুবা আহমদেকে জানালে তিনি বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে গত ২৫ জুলাই তারিখে তাঁর কার্যালয় থেকে সওজের কিশোরগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। যার একটি অনুলিপি দেওয়া হয় জেলা প্রশাসক মহোদয় এবং সওজের ভৈরবের উপবিভাগীয় প্রকৌশলীকে। সেই চিঠিতে সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু দ্রুত মেরামতের অনুরোধ জানানো হলেও,আজ পর্যন্ত চিঠির কার্যকারিতা পাওয়া যায়নি।
ইউএনও আরো জানান, জনদুর্ভোগ লাঘবে তিনি অচিরেই আবারও ওই বিভাগকে চিঠি লিখবেন।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে সওজের ভৈরবের উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়ে গিয়ে প্রকৌশলী রুহুল আমিনকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে রুহুল আমিন বলেন, রাস্তাটি জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-কটিয়াদী-ভৈরব মহাসড়ক প্রকল্পের অধীনে দুইলেন করা হবে। সেই লক্ষ্যে দুটি প্যাকেজের আওতায় প্রায় ১৮৭ কোটি টাকার দরপত্র প্রক্রিয়া শেষের পথে। সেই প্রক্রিয়া শেষ হলে অচিরেই সড়কটির কাজ বাস্তবায়ন করবে সওজ।
রুহুল আমিন আরো বলেন, যেহেতু সড়কটি মহাসড়কে উন্নীত করা হবে, আপাতত এই সড়ক মেরামত খাতে কোনো বরাদ্দ আশা করা যায় না।
তবে কি জনদুর্ভোগ সহসা দূর হচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে সওজ কর্মকর্তা হ্যাঁ বা না উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন