রাজধানীর বনানীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে গুলি করে ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় চার কিলারকে খুঁজছে পুলিশ। বনানী বি ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ১১৩ নম্বর বাড়ির প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে চার যুবককে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওই চার দুর্বৃত্ত মুন্সি ওভারসীজে ঢুকে হত্যা করে প্রতিষ্ঠানের মালিক সিদ্দিক হোসেনকে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুসারে মঙ্গলবার রাত ৭টা ৪৯ মিনিটে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে তারা। ফুটেজে দেখা গেছে, তাদের পরনে জিন্সের প্যান্ট ও শার্ট ছিল। এরমধ্যে একজনের পরনে ছিল টি-শার্ট।
অন্য একজনের মাথায় ক্যাপ। ক্যাপ ও টি শার্ট পরিহিত দুজন আলাদাভাবে দ্রুত হেঁটে ওই প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। বাকি দুজনকে একসঙ্গে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। প্রত্যেকের মুখে কাপড় বাঁধা থাকায় পুরো মুখ দেখা যায়নি। তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহজাহান সাজু জানান, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে চার কিলারকে দেখা গেছে। তাদের শনাক্ত করতে তৎপরতা চলছে বলে। কি কারণে কারা তাকে হত্যা করেছে- এ বিষয়ে ধারণা নেই নিহত সিদ্দিক হোসেনের পরিবারের সদস্যদেরও। নিহতের ভাই আব্দুল লতিফ বলেন, কারা, কেন আমার ভাইকে হত্যা করেছে তা আমাদের জানা নেই। আমরা জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।
গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিদ্দিক হোসেনের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, সিদ্দিক হোসেনের হাতে ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরমধ্যে হাতের গুলিটি একদিকে ঢুকে অন্যদিকে বের হয়ে গেছে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তিনি। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিকল্পিতভাবে সিদ্দিক হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে। কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের আড়াল করতে মুখ ঢেকে এসেছিলো। ঘটনার সময় মুন্সি ওভারসিজের মালিক সিদ্দিক হোসেন ছাড়াও আটজন কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিষ্ঠানে ঢুকেই অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কর্মচারীদের জিম্মি করে দুর্বৃত্তদের দুজন। বাকি দুজন সিদ্দিক হোসেনের কক্ষে ঢুকে। আবু জাফর নামে একজন কর্মচারী জানান, সিদ্দিক হোসেনের কক্ষে ঢুকেই তারা কয়েকটি গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন সিদ্দিক হোসেন। তখন কক্ষের ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে তিন কর্মচারী আহত হন। এসময় ড্রয়ার খুলে টাকা লুটে নেয় তারা। দুর্বৃত্তরা বের হয়ে যাওয়ার সময় কর্মচারীদের গালি দিয়ে বলেছিলো, দেখলি তো পরিণতি। আমরা ডনের লোক। তোরা বাঁচতে চাইলে ২০ লাখ টাকা নিয়ে যোগাযোগ করিস।’ এসময় বাইরে থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটক আটকে দেয় কিলাররা। তারা চলে যাওয়ার পর কর্মচারীরা চিৎকার করলে নিরাপত্তাকর্মীরা এগিয়ে গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। পরে আহতদের গুলশানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় আহতরা হচ্ছেন, মোস্তাফিজুর রহমান (৪০), মোখলেসুর রহমান (৩৮) ও পারভেজ আহমেদ (২৭)। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বি এম ফরমান আলী বলেন, চাঁদাবাজি নাকি অন্য কোনো কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনায় নিহত সিদ্দিক হোসেনের স্ত্রী জোছনা আক্তার বাদী হয়ে মামলা করেছেন বলে জানান তিনি।
নিহত সিদ্দিক হোসেনের তিন সন্তানের মধ্যে শারমিন সুলতানা একটি বেসরকারি মেডিকেলের ছাত্রী, সাদিয়া আক্তার এসএসসি পরীক্ষার্থী, একমাত্র ছেলে মেহেদি হাসান পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে। রাজধানীর উত্তরার চার নম্বর সেক্টরের সাত নম্বর সড়কের বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করতেন সিদ্দিক হোসেন।
এদিকে রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স মুন্সি’র মালিক ব্যবসায়ী মো. সিদ্দিক হোসেনের হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ ও গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে ইস্কাটনের সংগঠনটির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ উদ্বেগ জানানো হয়। একইসঙ্গে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। আজ এজেন্সিটির অফিসে কালো কাপড় পরে দিনব্যাপী অবস্থানের কর্মসূচি নিয়েছে সংগঠনটির নেতারা। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে বায়রা সভাপতি সাবেক এমপি বেনজির আহমেদ বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসা হুমকির মুখে পড়ে গেল। তিনি বলেন, প্রতি বছর এই সেক্টরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৩-১৪ বিলিয়ন রেমিটেন্স পাচ্ছে। নানারকম লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেও এজেন্সির মালিকরা এই ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, এই সেক্টরে এতোবড় আঘাত আসবে তা কখনো চিন্তাও হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সেক্টরটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বায়রা মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন বলেন, মো. সিদ্দিক হোসেন ১৬টি বছর এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোথাও একটি অভিযোগও নেই। এমন একজন মানুষ আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, এই সেক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে দেশের বৃহৎ ক্ষতি হয়ে যাবে। এই সেক্টরে অনেক রকম চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় উল্লেখ করে রুহুল আমিন স্বপন বলেন, আমরা বিশ্বাস করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধীদের খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কারো ব্যাপারে সন্দেহ হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বায়রা মহাসচিব বলেন, তিনি মধ্যম শ্রেণির ব্যবসায়ী এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। এসব কারণে এই হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু তারা পাচ্ছে না।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ দিনব্যাপী বনানীর মেসার্স মুন্সি রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে বায়রার সদস্যরা কালো কাপড় পরে অবস্থান করবেন বলে জানান সংগঠনটির সভাপতি বেনজির আহমেদ। সেখান থেকে তারা হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানাবেন। পরে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
বায়রা সদস্য হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ নেতৃবৃন্দের কাছে নিহত সিদ্দিকের পরিবারকে বায়রার পক্ষ থেকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা অনুদান দেয়ার দাবি জানান। একইসঙ্গে তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে ১ কোটি টাকা অনুদান আদায়ে নেতৃবৃন্দের কাছে অনুরোধ করেন। সংবাদপত্রে আদম ব্যাপারী লেখার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে বায়রা সভাপতি বলেন, এতে তাদের ব্যবসাকে ছোট করা হয়। যাদের মাধ্যমে দেশে বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে তাদের আদম ব্যাপারী হিসেবে সম্বোধন যেমন দুঃখজনক তেমনি ক্ষতিকর। সভাপতি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন অফিস থেকে তাদের কাছে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কার কথা বলছে। একইসঙ্গে বিদেশগামীদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে সরকারের কাছে জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা বাড়ানোর অনুরোধ করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন