কেনাকাটা, ভবন নির্মাণ ও উপবৃত্তি প্রদানে অনিয়মসহ বিভিন্ন খাতে শতকোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা খাত বিনিয়োগ কর্মসূচি (সেসিপ) প্রকল্পে।
মাউশির তথ্যানুযায়ী, সেসিপ প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ ধরা হয় ৭৯৩ কোটি টাকা। জানা গেছে, এ প্রকল্পে ১৩২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা অডিট আপত্তি রয়েছে। সিপিটিইউর ওয়েবসাইটে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে দরপত্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কাজে দেরি হলেও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হয়নি। আদায় হয়নি ভ্যাট ও আয়কর। এ ছাড়া দরপত্র মূল্যায়নে বাইরের প্রতিনিধি রাখা হয়নি। কাজের অতিরিক্ত বিল এবং ভুলভাবে পরিমাপ বইয়ে অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া অর্পিত সম্পত্তির ওপর নির্মিত স্কুল ভবনের জন্য নিয়মবহির্ভূতভাবে বিল পরিশোধ করা, প্রশিক্ষণ মালামালের জন্য জেলাপর্যায়ে স্টক ও ইস্যু বই সংরক্ষণ না করা এবং ল্যাব টেস্ট ছাড়াই এমএস রডের বিল পরিশোধ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পুরনো মডেলের কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করে বিদ্যালয় ও শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হলেও মান রক্ষা করা হয়নি। তাই ইতোমধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে বিভিন্ন বিদ্যালয় ভবনে। নিম্নমানের হওয়ায় চেয়ার-টেবিলসহ অন্যান্য আসবাব নষ্ট হতে শুরু করেছে। উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী বাছাই প্রক্রিয়াও যথাযথভাবে হয়নি বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
শিক্ষকদের অভিযোগ, প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অনেক পুরনো মডেলের কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে আধুনিক ভার্সনের প্রয়োজনীয় অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা যায় না। সরবরাহ করা কম্পিউটারের বেশিরভাগই প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। ই-লার্নিং পরিচালনার জন্য বিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিষয়ে স্পেশালাইজড কোনো শিক্ষক নেই। বিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ পানির জন্য নলকূপ স্থাপন করা হলেও সেগুলো আর্সেনিকমুক্ত কিনা তা যাচাই করা হয়নি। আবার ১৪৪টি বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট নির্মাণ করা হলেও পানির ব্যবস্থা নেই। ৯২ শতাংশ বিদ্যালয়ে লাইব্রেরি থাকলেও শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই।
সৃজনশীলে শিক্ষকরা ভালোভাবে প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক প্রশ্ন বোঝাতে পারলেও প্রয়োগ করতে ও উচ্চতর দক্ষতাবিষয়ক প্রশ্নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে পারছেন না। ফলে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের গাইডবই ও প্রাইভেট পড়তে উৎসাহিত করেন। সৃজনশীলের প্রভাবে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অথচ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে সৃজনশীলের পথে হাঁটে সরকার। শিক্ষকরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা।
সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় আটশ কোটি টাকা। অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয় এ প্রকল্পের আওতায়। কিন্তু কোনো কাজই সঠিকভাবে হয়নি। সাড়ে ৭ বছরে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও কোনো নিয়মনীতি না মানার এবং ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, প্রকল্পের যেসব অডিট আপত্তি উঠেছে তা আমার যোগদানের আগের সময়কালের। এখন যেসব প্রকল্প চলমান আছে, সেগুলোর অগ্রগতি নিয়ে প্রতিমাসে একবার মিটিং করছি। এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো উত্থাপন হচ্ছে, সমাধান হচ্ছে। অডিট আপত্তিসহ সব ধরনের অনিয়ম রোধে বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মনিটরিং।
মাউশির তথ্যানুযায়ী, সেসিপ প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ ধরা হয় ৭৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ৫৯৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় ধরা হয়। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিলÑ দারিদ্র্য বিমোচনের স্থায়ী সমাধান ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণের উপযোগী মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা। সেই অনুযায়ী এর নামকরণ হয়, ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (এসইএসআইপি)’। এর আওতায় শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন-পরিমার্জন, বিস্তরণ, পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন তথা সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালুকরণ, বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়ন প্রচলন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন তথা ই-লার্নিং পাইলটিংয়ের জন্য ২০টি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো প্রস্তুত করা হয়।
এ ছাড়া ৩৫টি মডেল মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন, ২৫০টি বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ৬৬টি নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে মাউশি, নায়েম, এনসিটিবি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কর্মক্ষমতা ও সক্ষমতা বাড়ানো।
প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু ইতিবাচক দিক পাওয়া গেছে, সারা দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্যসংবলিত একটি ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে। সেখানে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য হালনাগাদ করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। আইএমইডি পরিচালিত সমীক্ষায় ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ আছে। উপবৃত্তি পাওয়ার ফলে সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন